আরফাতুল ইসলাম নাইম, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:০৯ | আপডেট: ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:১৫
ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রিন্ট মেকিং বিভাগে প্রায় একযুগ পর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিন শিক্ষক। তবে কারোর-ই বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পূরণ হয়নি। অথচ তাদেরকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নিয়োগ পাওয়া তিন শিক্ষক হলেন- আব্দুল্লাহ আল বশির, ঝোটন চন্দ্র রায় ও স্বপন কুমার সানা।
শিক্ষক নিয়োগের শর্তানুযায়ী, প্রার্থীর এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫-এর মধ্যে ন্যূনতম ৪.২৫ ও প্রিন্ট মেকিং বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় সিজিপিএ ৪ এর মধ্যে অন্তত ৩.৫০ বা ১ম শ্রেণি থাকতে হবে। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতায় এই তিন শিক্ষকের আবেদনের শর্তই পূরণ হয়নি। যদিও আবেদনকারীদের মধ্যে যোগ্যতম প্রার্থী ছিলেন বলে জানা গেছে।
নিয়োগ পাওয়া তিন শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, ঝোটন চন্দ্র রায় এসএসসিতে ৩.৮৮ ও এইচএসসিতে ৪ পেয়েছেন। আর আব্দুল্লাহ আল বশির এইচএসসিতে জিপিএ ৫-এর মধ্যে পেয়েছেন ৩.৫০। এ ছাড়া, স্বপন কুমার সানা এসএসসিতে জিপিএ ৫-এর মধ্যে পেয়েছেন ৪। এসব ফলাফল থেকে বোঝা যায়, কেউ-ই আবেদনের শর্ত পূরণ করতে পারেননি। অথচ একই নিয়োগ বোর্ডে একজন প্রার্থী ছিলেন যিনি সব পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ । কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে এই তিনজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ঢাবি প্রশাসন।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, স্বপন কুমার সানা ড্রয়িং ও পেইন্টিং বিভাগের অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র গাইনের পারিবারিক সদস্য। তিনি আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক ও চারুকলা অনুষদ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তাই, দুলাল চন্দ্র গাইনের সুপারিশে স্বপন কুমার সানাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় প্রশাসন। আর ঝোটন চন্দ্র রায় চারুকলা অনুষদের সাবেক ডিন নিসার হোসেনের একান্ত অনুগত ছিলেন। তাই, নিসার হোসেনের সুপারিশে ঝোটনকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে আব্দুল্লাহ আল বশির সাবেক উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালের একান্ত ব্যক্তি। এমনকি সাবেক উপাচর্যের একান্ত ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তাকে চীন সফরেও পাঠানো হয়। মাকসুদ কামালের সুবাদে তাকে নেওয়া হয়েছে। অথচ একই বিভাগের এক শিক্ষার্থীর চারটা ফার্স্ট ক্লাস থাকার পরও নিয়োগ পাননি।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট এক সিন্ডিকেট সভায় এই তিন জনকে শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে ১০ আগস্ট নির্বাচনি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে নির্বাচন কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন- সাবেক উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল, সাবেক চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন, প্রিন্ট মেকিং বিভাগের চেয়ার শাম্মী আক্তার, অধ্যাপক মো. আনিসুজ্জামান এবং চিত্রকর ও কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী। নিয়োগের বিষয়ে জানতে সাবেক উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল ও সাবেক ডিন নিসার হোসেনকে একাধিকবার ফোনে কল করেও পাওয়া যায়নি।
তবে নিয়োগের বিষয় জানতে চাইলে প্রিন্ট মেকিং বিভাগের চেয়ারম্যান আস্মিতা আলম শাম্মি বাংলানিউজবিডিহাবকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ত মোতাবেক আমরা শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। যেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যথাযথ নিয়মে করা হয়েছে। সেটার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বমোট ১৯ জন চাকরি প্রত্যাশী আবেদন করেছিলেন। যা আমরা সিএনডি’র মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে যাচাই-বাচাই করে এই সাতজনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। পরে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই তিনজনের এক্সিলেন্স অনুসারে প্রশাসন যাদের যোগ্য মনে করেছে তাদের নিয়োগ দিয়েছে।’
যোগ্যতায় প্রথম হয়েও বাদ এক প্রার্থী
আবেদকারীদের যে চার পরীক্ষায় শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে তার সবগুলোতে প্রথম স্থানে রয়েছে নাদিয়া ইয়াসমিন নামের এক প্রার্থীর। এর বাইরেও তিনি অন্তত ২২টি দেশি-বিদেশি চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু, তাকে বাদ দিতেই তার কোনো প্রদর্শনীর কথা মৌখিকের জন্য পাঠানো তালিকায় উল্লেখ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক উপাচার্য মাকসুদ কামালের নির্দেশে এসব তথ্য সরিয়ে ফেলেছেন প্রশাসন-১ এর দায়িত্বে থাকা ডেপুটি রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান। তিনিই উপাচার্য মাকসুদ কামালের একান্ত লোক ছিলেন বলে জানা গেছে। তাই, তাকে প্রশাসন-১ এ বসিয়েছেন মাকসুদ কামাল। যিনি এখনো স্বপদে বহাল আছেন।
এ বিষয়ে নাদিয়া ইয়াসমিন বাংলানিউজবিডিহাবকে বলেন, ‘আমার বাবা একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি মারা গেছেন। তাই, আমাদের সুপারিশ করার মতো কেউ ছিল না। এছাড়া পরিবারের কেউ রাজনীতিতে না থাকায় আমি নিয়োগ পায়নি।’
এ বিষয়ে বর্তমান প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা? জানতে চাইলে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ বাংলানিউজবিডিহাবকে বলেন, ‘আপনি যেটা বললেন সেটা অনিয়ম ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া। এ রকমটি ঘটলে সেটা জানার জন্য ওই বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়। এর পর অনিয়ম পাওয়া গেলে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে একটি কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাচাই করা হয়। এর পর সেটা নিয়ে সিন্ডিকেটে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এ রকম অনিয়ম যদি কোথাও হয়ে থাকে সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সাইমা হক বিদিশা বাংলানিউজবিডিহাবকে বলেন, ‘আপনার কাছ থেকে বিষয়টি অবগত হলাম। এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বাংলানিউজবিডিহাবকে বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখতে এরই মধ্যে আমরা তিনটি কমিটি গঠন করেছি। এই বিষয়টিও কমিটিতে আসবে। তখন আমরা প্রতিবেদন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
বাংলানিউজবিডিহাব/এআইএন/পিটিএম
চাকরির শর্ত
চারুকলা অনুষদ
প্রিন্টিং মেকিং বিভাগ
শিক্ষাগত যোগ্যতা