বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যাগত দিক কমে গেলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। এমনকি এসব ঘটনায় অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ‘মব জাস্টিস’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার দ্বারা বিচারের নামে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও উদ্বেগজনক। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসকে) ২০২৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এক পর্যবেক্ষণমূলক বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে।
ASK 2024 এর পরিসংখ্যান অনুসারে, 21 জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে মারা গেছেন। এদের মধ্যে ছয়জন পুলিশ হেফাজতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, তিনজন পুলিশের গুলিতে এবং একজন পুলিশ হেফাজতে আত্মহত্যা করেছে। র্যাব হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে একজন, বিজিবির ক্রসফায়ারে একজন মারা গেছে, যৌথ বাহিনীর হেফাজতে গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতনে সাতজন, নৌবাহিনীর নির্যাতনে একজন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হেফাজতে একজন মারা গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই ২১ জনের মধ্যে ১২ জন মারা যান। যদিও নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি দেশের সংবিধান এবং প্রথাগত আইনে নিষিদ্ধ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা এই ধরনের অনুশীলন বা আচরণের সাথে জড়িত ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। আটককৃতদের কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ে থানায় ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
কথিত সন্ত্রাসী এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য আহরণের জন্য আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের নির্যাতনের অবলম্বন করা সাধারণ ব্যাপার ছিল। স্বাধীন জবাবদিহিতা ব্যবস্থার অভাব এক ধরনের দায়মুক্তির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। যদিও অত্যাচারের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো পুলিশের অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করার কথা, কিন্তু তদন্তে বিচার পাওয়া কারো জন্য নজিরবিহীন ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সাল ছিল বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল বছর। এ বছর সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে বহু বছর ধরে আইনের শাসনের অভাব রয়েছে। এছাড়াও, দায়মুক্তির সংস্কৃতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। আগের শাসনামলে এসবের সঙ্গে যুক্ত ছিল ভয়ের সংস্কৃতি। মানবাধিকারের বিষয়টি দেশের সংবিধান ও আইনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আর আইন ও সংবিধান বাস্তবায়নের দায়িত্ব যেহেতু সরকারের, তাই মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সরকারের বিষয়টি উঠে আসে। 2024 সালে জাতীয় জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। যার প্রভাব ছিল মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপরও। ১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন এবং বছরের মাঝামাঝি যৌথ ছাত্র অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের অবসান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 2024 সালে লিঞ্চিংয়ের ঘটনায় 128 জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৫৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭ জন, খুলনা বিভাগে ১৪ জন, বরিশাল বিভাগে ৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫ জন, রংপুর বিভাগে ৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ৪ জন নিহত হয়েছেন। 2023 সালে, গণহত্যায় 51 জন নিহত হয়েছিল।
‘মব জাস্টিস’ উল্লেখ করে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি সমালোচনার ঝড় তোলে। চলমান পরিস্থিতিতে গণপিটুনি বা গণবিচারের মতো ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা নিহত হচ্ছেন। গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে। পরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় থানায় হস্তান্তর করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর মাঝরাতে তার মৃত্যু হয়। মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে হামলার শিকার হয়ে তিনি ডান পা হারান। বাম পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি কৃত্রিম পা নিয়ে হাঁটতেন।
গণঅভ্যুত্থানে 858 জন নিহত হন
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হেলথ ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৮৫৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১ হাজার ৫৫১ জন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সূত্র থেকে আসকের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ১১ জন নারী এবং ১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোর রয়েছে। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের সময় শিশুদের নিজেদের বাড়িতে গুলি করে হত্যার ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। এছাড়া নিহতদের মধ্যে ছাত্র, কর্মী, পেশাজীবী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী রয়েছেন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু
আস্কের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ১৪৭টি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৪০৮টি বাড়িতে হামলা ও ভাংচুর, ৩৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুরের 113টি, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মন্দির ও মসজিদে 32টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুর করা হয়েছে ৯২টি মূর্তি। এসব ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩ জন এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একজন নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৮২ জন।
আদিবাসী অধিকার
এএসকে বলেন, বিগত বছরের মতো ২০২৪ সালেও সমতল ও পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে বান্দরবানের লামা উপজেলার সরাই টঙ্গোঝিরি এলাকায় পূর্ব-বেচারাপাড়ার ১৭টি ত্রিপুরা পরিবারের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গ্রামবাসীর অভিযোগ, এর আগেও দুষ্কৃতীরা তাদের কাছে টাকা দাবি করেছিল। এরপর ঘরে আগুন লেগে যায়।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরে বুধবার মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় মারধরের ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারিয়েছেন মামুন নামের এক যুবক। মূলত এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি বাঙালিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ ঘটনায় ৪ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েছেন। বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়।
বিগত সরকারের পতনের পর উত্তরাঞ্চলে হামলা, লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে। গত ৫ থেকে ৭ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন স্থানে দুর্বৃত্তরা প্রায় ৭০টি আদিবাসী পরিবারের ওপর হামলা চালায়। বিশেষ করে দিনাজপুরের ছয় উপজেলায় উপজাতীয়দের ওপর হামলা হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে দেশের একমাত্র সিধু-কানুর ভাস্কর্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সমান অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার ও সুশীল সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যেমন- বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিচারবহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অবিলম্বে এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা উচিত এবং জড়িতদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শাস্তি দেওয়া উচিত এবং সরকারের পক্ষ থেকে মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য আইন ও প্রবিধান। সালিশ কেন্দ্র সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে।