এমপির বন্ধু পরিচয়ে শিক্ষকের সম্পদের পাহাড়!

Featured Image
PC Timer Logo
Main Logo

জোয়ারিয়ানালা হাজী মোহাম্মদ সাঁচি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক

কক্সবাজার: ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী এক এমপির বন্ধু পরিচয় দিয়ে দুর্নীতির পাহাড় গড়েছেন রামু’র জোয়ারিয়ানালা হাজী মোহাম্মদ সাঁচি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক। এই শিক্ষকের দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ্যে আসা এবং তা প্রমাণিত হতে যাওয়াকে লজ্জাজনক বলছেন শিক্ষক সমাজ। এতে হতাশার পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ওই বিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণ। এই শিক্ষকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে সংশ্লিষ্ট দফতরে অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, রামু’র জোয়ারিয়ানালা হাজী মোহাম্মদ সাঁচি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক ২০১০ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কিছুদিন ঠিকঠাক থাকলেও তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী এমপি’র বন্ধু পরিচয়ে নানা সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি টাকা আত্মসাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করে। তার আর্থিক অনিয়মের ফল পর পর দু’টি পরিচালনা কমিটির কাছে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালে আত্মসাৎকৃত ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৪৫ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ওই সময় তার বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবি উঠলেও দোসরের আশ্রয়ে রক্ষা পেয়ে স্বপদে বহাল থাকে। পরে কৌশল পাল্টে কয়েকজন শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নতুন মিশনে নামেন। এ ছাড়া, বিভিন্ন খাত দেখিয়ে বিনা রশিদে শিক্ষাবোর্ডের নির্ধারিত ফি’র বেশি টাকা আত্মসাৎ করে আসছে গত ছয় বছর ধরে।

এই অপকর্মের প্রতিবাদ যাতে কেউ করতে না পারে সেজন্য এমপি’র বন্ধু পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে তৎকালীন প্রভাবশালীদের নিয়ে কমিটি গঠন করে। ২০২৪ এর জানুয়ারি থেকে হিসাবের কোনো আপডেট নেই। এছাড়া হিসাবের ক্যাশ বইয়ের প্রায় প্রতিটি পাতায় ফ্লুইড দিয়ে ওভার রাইটিং করা। তিনি দুর্নীতির টাকায় গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। রামু উপজেলা সদরে তিনি ছয়তলা ফাউন্ডেশন ভবন করেন। যার দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এত টাকার উৎস নিয়েও প্রশ্ন উঠে অনেকের মনে। তার দুর্নীতি গোপন রাখতে ওই বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর রাজিব পালকে জিম্মি করে রাখে তিনশ টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প নিয়ে। এ ছাড়া, ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী মাহফুজকে দিয়ে যাবতীয় অপকর্ম চালিয়েছেন। যা লিখিতভাবে স্বীকার করেন ভোক্তভোগী রাজিব পাল।

এ ছাড়া, ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত দু’টি শ্রেণি শাখা খোলার অনুমোদন পায়। ওই অনুমোদনের পর ২০১৩ সালে সাজেদা বেগমকে অতিরিক্ত শ্রেণি শাখার জন্য সামাজিক বিজ্ঞান পদের বিপরীতে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের পর প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক অতিরিক্ত শ্রেণি শাখার জন্য নিয়োগ দেওয়া তথ্যটি গোপন করে সাজেদা বেগমের এমপিও আবেদন ফরোয়ার্ড করেন। এতে সাজেদা বেগম ২০১৪ সালে এমপিওভুক্ত হয়ে হন। এই নয়-ছয় করে তিনি সাজেদা বেগমকে চার বছর অবৈধভাবে বেতন-ভাতা ভোগ করার সুযোগ করে দেন। আজিজুল হক মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এই কাজ করেছে বলে এলাকায় প্রচার রয়েছে। বেতন ভাতা খাতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩০ লাখ টাকা।

তার দুর্নীতির সুবিধার্থে আব্দুল কাইয়ুম নামে এক রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে সহযোগিতা করে কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর পদে নিয়োগের জন্য। বিষয়টি নিয়ে কথা উঠলে আব্দুল কাইয়ুমের তথ্য যাচাই-বাছাই প্রতিবেদনে জনপ্রতিনিধিদের সই জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। পরে রশিদ নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মালেক মাসুম জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা এই জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করেন।

এ ছাড়া, আজিজুল হকের বিরুদ্ধে ক্লাস না নেওয়া, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে আশালীন আচরণ, কোচিং বাণিজ্য, উপবৃত্তি প্রাপ্য শিক্ষার্থী নির্বাচনে স্বেচ্ছাচারিতা, করোনাকালে প্রধামন্ত্রীর দফতর থেকে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকার ফান্ড যথেচ্ছা ব্যবহার, বিজ্ঞানাগারের যন্ত্রপাতি কেনা টাকা আত্মসাৎ, বিদ্যালয়ের জন্য এনজিও কর্তৃক দেওয়া ল্যাপটপ ও মোবাইল আত্মসাৎসহ মিথ্যা বিল-ভাইচার করে বিদ্যালয়ের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া, উনি যোগদানের পর এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। যা বিগত এসএসসি পরিক্ষার ফলাফলে প্রতীয়মান হয়।

প্রধান শিক্ষক আজিজুল হকের এতসব দুর্নীতি নিয়ে লজ্জার পাশাপাশি হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক, সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণ। এলাকার সচেতন ব্যক্তি ও অভিভাবক মোহাম্মদ হোসেন জানান, প্রতিষ্ঠানটি এলাকার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। এই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা অনেক শিক্ষার্থী আজ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিচারকসহ সমাজের ভালো ভালো অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য দিন দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার মান কমে যাচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে।

সাবেক শিক্ষার্থী ডাক্তার আবদুল মজিদ বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আজ ভালো ভালো অবস্থানে রয়েছে। কেউ এই প্রতিষ্ঠানের মান ক্ষুন্ন করলে শিক্ষার্থীরা তা মেনে নেবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে দুর্নীতি করলে আইনের আওতায় আসতে হবে।’ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মির কাসেম বলেন, ‘বিদ্যালয়ে পুকুরচুরি হয়েছে। আমি তখন ব্যবস্থা নিতে গিয়েও কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় পারিনি। বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাই।’

সাবেক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন জানান, একজন শিক্ষক সমাজের দর্পণ। কোনো শিক্ষক যদি এই ধরনের অপরাধ করে থাকেন তাহলে বিষয়টি লজ্জাজনক। তবে বিষয়টি তদন্ত করা দরকার। তদন্ত করে যদি অপরাধ প্রমাণিত হয় তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি না হয় তাহলে দেখতে হবে শিক্ষকের মান যেন ক্ষুন্ন না হয়।’ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) রাম মোহন সেন বলেন, ‘শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে ওই শিক্ষক যদি অপরাধ করেন তাহলে অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া উচিত। একইভাবে নিরপরাধ হলে শিক্ষককে হয়রানি করা যাবে না’।

এ প্রসঙ্গে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে তা ষড়যন্ত্র। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। সরকার পতনের পর এই অভিযোগগুলো আনা হচ্ছে। এর আগে এমনটা হয়নি।’

এদিকে স্কুল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে সর্বস্তরের জনগণ প্রধান শিক্ষক আজিজুল হকের পদত্যাগের দাবিতে ১৮ আগস্ট থেকে অবস্থান কর্মসূচি ও লাগাতার ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল। ছাত্র-জনতার এই কর্মসূচির মুখে ১৮ আগস্ট থেকে ছয় মাসের জন্য শিক্ষক আজিজুল হক ছুটিতে যেতে বাধ্য হন। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ তালিব উল্লাহ ছিদ্দিকী। আজিজুল হকের ছুটির মেয়াদ শেষে হবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি।

এদিকে আজিজুল হক ছুটি শেষে পুনরায় তিনি স্বপদে ফিরে আসার জন্য নানা ফন্দি-ফিকির করছেন বলে ধারণা করছেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রক্ষার দাবি তুলেছেন শিক্ষক, সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের জনগণ।

বাংলানিউজবিডিহাব/পিটিএম

এমপি
পাহাড়
বন্ধু
শিক্ষক
সম্পদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।