নারায়ণগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজদের স্বজনরা লিংক রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এতে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন। ঘণ্টাখানেক পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। রোববার (২৯ ডিসেম্বর) দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কের একপাশ অবরোধ করে তারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজদের স্বজনরা হাতে ছবি নিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে তারা। এতে সড়কের একপাশে যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাফর সাদিক চৌধুরী তাদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন।
সড়ক অবরোধকারী স্বজনরা জানান, ২৫ আগস্ট রাতে রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানায় হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর থেকে তাদের পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ রয়েছে। তারা মৃত না জীবিত তাও জানে না। এমনকি তারা মারা গেলে তাদের লাশ ও হাড় দেওয়ার দাবি জানায়। তারা গত চার মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন। এভাবে দিনের পর দিন তারা স্বজনদের ফিরে পাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কাউকে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় অনেক পরিবারের রুজির মালিক নিখোঁজ হওয়ায় অনেক পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ অবস্থায় তারা সড়ক অবরোধ করেন।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক জানান, গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ১৮২ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা তৈরি করে। কিন্তু আসলে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা যাচাইয়ের জন্য পুলিশ সুপারের কাছে পাঠানো হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার জানান, এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তদন্ত চলছে। ডিএনএ রিপোর্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেখানে একটি জিডিও হয়েছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।
এর আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন দেয় ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট কারখানায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ টাকার বিনিময়ে স্থানীয় কয়েকজনকে কারখানা পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেয়। কিছুদিন পর পাহারার দায়িত্বকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ গঠিত হয়। নিরাপত্তার জন্য একটি পক্ষ কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে। কারখানা কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে। এরপর গত ২৫ আগস্ট হুমকি দিয়ে কারখানা ত্যাগ করেন।
এদিকে গাজী টায়ার কারখানার মালিক গোলাম দস্তগীর গাজী (সাবেক সংসদ সদস্য)কে গ্রেফতারের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ২৫ আগস্ট আনন্দ মিছিল বের করে এলাকার মানুষ। সকাল সাড়ে ১১টায় খাদুন উত্তরপাড়া জামে মসজিদ (খান পাড়া) থেকে ঘোষণা আসে রূপসী মোড়ে এবং বেলা ৩টায় খাদুন মোড়ে জমায়েত হওয়ার। একপর্যায়ে দুপুর ১২টার দিকে দুর্বৃত্তরা কারখানায় প্রবেশ করে কারখানা থেকে প্রায় ১৮০ জন শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বের করে দিয়ে লুটপাট শুরু করে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে অপর একদল দুর্বৃত্ত কারখানায় ঢুকে লুটপাট শুরু করে। পরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। দুর্বৃত্তরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বিকেলে কারখানার ভেতরে লুটপাট শুরু করে। লুটপাটকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের একপর্যায়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাজী অটো টায়ার কারখানার ৬ তলায় একটি পাকা মিক্সিং ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ভবনের প্রতিটি তলায় বিভিন্ন মালামাল ও যন্ত্রপাতি পুড়ে গেছে। ফলে ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। আর গণশুনানিতে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষার্থী ও তদন্ত কমিটি বিভিন্ন তালিকা তৈরি করে। তালিকাগুলি একত্রিত করে মোট 182টি নিখোঁজ ব্যক্তির ঠিকানা পাওয়া গেছে।
তাছাড়া ৫ আগস্ট থেকে কারখানাটি বন্ধ থাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন না। এমনকি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীও নিখোঁজ নেই। আগুন লাগার দিন থেকে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ফলে গ্যাস ও বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকায় আগুন লাগেনি।
ফায়ার সার্ভিসের মতে, ভারী দাহ্য পদার্থের কারণে ভবনটি নিয়ন্ত্রণ করতে 21 ঘণ্টা সময় লেগেছিল এবং 30 আগস্ট সন্ধ্যা 7:55 মিনিটে সম্পূর্ণভাবে নিভে যায়। . পরে ভবন থেকে কোনো লাশ উদ্ধার করা যায়নি। ১ সেপ্টেম্বর ভবনের ভেতরে ১৫টি মানুষের হাড় পাওয়া যায়।
ফায়ার সার্ভিস ভবনে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য মতামত জানতে চাইলে বুয়েট টিমসহ নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের প্রতিনিধিরা ফায়ার সার্ভিসের টিটিএল ও ড্রোন নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের বিভিন্ন তলা পরিদর্শন করেন। ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলার ছাদ ধসে তৃতীয় তলায় পড়ে এবং কলামগুলো ভেঙে যায়। আগুনের তীব্রতা বেশি হওয়ায় ভবনের আরসিসি পিলার, বিম ও ছাদের ঢালাই ধসে পড়তে দেখা গেছে। অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে বিভিন্ন মেঝের বিম এবং ছাদের রড বাঁকানো এবং অমসৃণ। ইটের দেয়াল বাঁকানো এবং হেলান দেওয়া। ফলে ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কমিটি বলেছে, উদ্ধার কাজ না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবনটি সরিয়ে ফেলতে হবে। এ কারণে ভেতরে উদ্ধার কাজ করা সম্ভব হয়নি।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন