গানের দেশ, আমাদের বাংলাদেশ – BanglaNewsBDHub.com |

Featured Image
PC Timer Logo
Main Logo



ছবি : সংগৃহীত

মানুষের প্রাণের ভাষা গান। গান তৈরি হয় মানুষের অন্তর্জগৎ থেকে। অন্তর্জগতের বিকাশের মধ্য দিয়েই তো গানের আবির্ভাব। গান মানুষের জীবনের দুঃখ, শোক, হাসি, কান্না প্রকাশ করার অন্য রকম এক ভাষা। কিন্তু আমরা যে গান করি, গীত গাই, কবিতা আবৃত্তি করি, সুন্দর ভাবে কথা বলি। এটাকি আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়। না! এটা আপনা-আপনি সৃষ্টি হয় না। তার জন্য লাগে সাধনা। এসব সাধনাকে বাচিক শিল্প বলা হয়। আমরা সবাই সুন্দরকে ভালোবাসি। স্পর্শ করতে চাই সুন্দরের শরীর, পান করতে চাই সুন্দরের অমৃত সুধা। সুন্দর বলতেই আমাদের কল্পনায় ধরা দেয় ভালো কিছু।

যদি বলা হয় ভালো কি? তখন আর আমরা ভালোকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি না। ভালো জিনিসের প্রতি আমাদের সবারই একটা দুর্বলতা আছে। আমরা যদি গ্রামের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখব কোন ছেলে/মেয়ে শহর থেকে গ্রামে এলে আমরা তার দিকে তাকিয়ে থাকি কারণ তার সাজসজ্জা গ্রামের চেয়ে অনেক উন্নত। [গ্রামের মানুষকে খাটো করার জন্য আমি এটি বলছি না] যখন সেই ছেলে বা মেয়েটা কথা বলে আমরা তা মনোযোগ দিয়ে শুনি বা প্রশংসা করি। যে সুন্দর করে কথা বলে তাকে বলা হয় চারুবাক। চারুবাক অর্থ আমরা অন্যভাবে বলতে পারি সুন্দরভাষী। শুধু যে কথা শুনেই আমরা অভিহিত হই তা নয়, যে ভালো গান করে আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি; সমাজের অন্য মানুষের চেয়ে আমরা তাকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখি। আর এমন কোন মানুষ আছে যে গান ভালোবাসে না। হোক না লোকগান বা আধুনিক গান বা পপগান। গান মানে জ্ঞান। গান মানুষের মনে এনে দেয় শান্তি, হৃদয়কে করে প্রসারিত। পরীক্ষা করে দেখা গেছে সাধারণ বৃক্ষের চেয়ে যে বৃক্ষকে প্রতিদিন গান শোনানো হয় সে বৃক্ষ অন্য বৃক্ষের চেয়ে বেশি তার শরীরে বৃদ্ধি ঘটায়। যে গান ভালো বাসে না সে সৌন্দর্যকে চোখমেলে দেখতে পারে না। যে গানকে ভালোবাসে না, সে মানুষ ভালোবাসতে পারে না। আজ আমরা যদি আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করি, তাহলে দেখব যে প্রাচীন কাল থেকেই গানের ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে। এই গান মানুষের জন্মের পর পরই এসেছে। কারণ মানুষ জন্ম গ্রহণ করেই যখন ক্রন্দন করে সেটাও তো গানের প্রকাশ। এ গানকে কখনও আমরা দুঃখ- ব্যথা প্রকাশের ভাষা হিসেবে, কখনও সুখ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে, কখনও বা প্রতিবাদীর ভাষা হিসেবে ব্যবহার করি। আবার কখনও উদ্দীপনার স্বর হিসেবে আমরা গানকে ব্যবহার করি।

প্রাচীনকালে মানুষ যখন চর্যাপদের সৃষ্টি করেছিল, সেটাও তো ছিল গানেরই এক বহিঃপ্রকাশ। শ্রমে উদ্দীপনা আনার জন্য শ্রমিকরা সম স্বরে গান করে, শ্রমজীবী মানুষ তাদের শ্রমকে লাঘব করার সময় গান করে, কৃষকেরা মাঠে-ঘাটে কাজ করার সময় গান করে, মাঝিরা নৌকা বাওয়ার সময়, গাড়োয়ানরা গাড়ি বাওয়ার সময়, গাড়ির চালকরা গাড়ি চালানোর সময়, জেলেরা জাল ফেলার সময় গান করে থাকে। এসব গানকে শ্রমজীবী মানুষের গান হিসেবে অভিহিত করা হয়। এসব ভাবে মানুষ শ্রমের সাথে বিনোদনকে যুক্ত করেছে। এসব বিনোদন তাদের শ্রমের সময় আনন্দ দান করে থাকে। আমাদের গ্রাম গঞ্জে গীত বলে একটা মহিলা গানের প্রচলন আছে। এ গীত আমাদের গানেরই অন্য একটা রূপ। এটা গ্রাম গঞ্জের বিয়ের উৎসব, সুন্নতে খাৎনায় গাওয়া হয়। কিন্তু আজ আর গীতের প্রচলন নেই বললেই চলে। সে সব জায়গা আজ স্থান করে নিয়েছে পপ সংগীত, ব্যান্ড সংগীত, আধুনিক গান ইত্যাদি।

মানুষের জীবনে আনন্দ আছে, দুঃখ আছে। এসব কিছু নিয়েই যেন মানুষের সৃষ্টি। মানুষ এসব আনন্দ কিংবা দুঃখ প্রকাশ করার জন্য গান রচনা করে; সেই গান আবার গাইও। অন্যরা গান শুনে বিমোহিত হয়। এই ভাবেই প্রাচীন কাল থেকেই গানের সাথে মানুষের মিতালী গড়ে উঠেছে। এক এক সময় মানুষ এক এক রঙ্গের সৃষ্টি করে। এসব রঙ্গকে আবার জাগ্রত রাখার জন্য প্রতিফলন ঘটায় কথায়, ছন্দে, ছড়ায়, কবিতায় বা সংগীতে। আমাদের দেশে এক এক অঞ্চলে এক এক বৈশিষ্ট্য বিরাজমান। তারা এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটায় গানে বা ভাষাই। তাই তো অনেকে বলেন এদেশ গানের দেশ। আমরা গান শোনার সময় শুনি; তার ভাব বুঝি। তাকে হৃদয়ে ধারণ করি। কোন কোন গান আমাদের হৃদয়ে ক্ষত তৈরি করে, কোন কোন গান আমাদের জাগরণের গল্প শোনায়, কোন কোন গান আমাদের মনকে উদ্দীপনা দান করে। কিন্তু এগান শোনা যতটা সহজ, গাওয়াটা ততো সহজ নয়। গান শেখার জন্য সংগীত সাধনা করার প্রয়োজন। গান শেখার জন্য প্রতিদিন রেওয়াজ করতে হয়। এ রেওয়াজ ছাড়া কোন গান শেখা যায় না। আর এ গানের রেওয়াজের জন্য একজন গুরুর সান্নিধ্যে যেতে হয়। তিনি তার শিষ্যকে সংগীতের তাল, লয়, সুর শিখিয়ে দেন। তার কথা মানার মধ্য দিয়েই একজন শিষ্য সংগীতের সঠিক সফলতা অর্জন করতে পারে। যখন মানুষ সুকণ্ঠ বা সুকণ্ঠী হয়ে ওঠে, তখন সে সবার প্রিয় পাত্র বা পাত্রী হয়। কিছু কিছু মানুষ তাদের সুমিষ্ট কণ্ঠ দ্বারা গান করে মানুষের প্রশংসা কুড়িয়ে এসেছে। তারা তাদের সংগীত দ্বারা মানুষের হৃদয়ে আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। যারা মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে আব্বাসউদ্দিন, আব্দুল আলিম, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, হাছন রাজা, লালন, গগন হরকরা, পাঞ্জু শাহ্, পাগলা কানাই, মনোমোহন দত্ত, রাধারমণ দত্ত, রমেশ শীল, বিজয় সরকার, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, আব্দুল করিম শাহ, আব্দুর রহমান বয়াতী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। গানের জন্য প্রয়োজন হয় যন্ত্রের। যন্ত্র ছাড়া কোন গান সুন্দর ভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না। তাই যন্ত্র বাজানোর দক্ষতাও জানতে হয়। যারা যন্ত্র সাধনা করেন তাদের মধ্যে আয়েত আলী খাঁ উল্লেখ যোগ্য। তিনি আমাদের জন্য গৌরব। যারা জীবনের ভালোবাসা উজার করে দিয়ে সংগীতের সাধনা করেন তাদেরকে বলা হয় সংগীত সাধক। আমাদের দেশে সংগীতের দুটো ধারা প্রবাহমানÑ কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীত।

কণ্ঠ সংগীতের মধ্যে রয়েছে দেশ-প্রেমের গান, প্রকৃতি প্রেমের গান, পালা-পার্বণ উৎসবের গান, পল্লীগীতি, লোকগীতি, উচ্চাঙ্গ সংগীত, আধুনিক, মারফতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি বিচ্ছেদী, গম্ভীরা, কবিগান, টপকা, আলকাপ, বাউলগান, বৈষ্ণব গান, ইত্যাদি। কণ্ঠ সংগীতের পরিপূরক হিসেবে যন্ত্রসংগীতের ভূমিকা অপরিসীম। তবে কণ্ঠ সংগীত যেমন সম্ভব, যন্ত্র সংগীতও তেমনই সম্ভব। যন্ত্রসংগীতের জন্য যেসব বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তা হল- ১. বাঁশি, ২. কাঁশি, ৩. ঢোল, ৪. হারমোনিয়াম, ৫. খঞ্জনি, ৬. মাদল, ৭. একতারা, ৮. দো-তারা, ৯. সেতার, ১০. সরোদ, ১১. তবলা, ১২. করতাল, ১৩. বেহালা, ১৪. খোল, ১৫. জুরি, ১৬. ঘন্টি, ১৭. ঝুনঝুনি ইত্যাদি। যারা এসব যন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন তাদের আবার বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমনÑ যিনি ঢোল বাজান তাকে বলা হয় ঢুলি, যিনি বাঁশি বাজান তিনি বাঁশিওয়ালা বা বংশিবাদক, যিনি তবলা বাজান তিনি তবলাচি।

শহরে যেমন সংগীতের চর্চা হয় তেমনই প্রাচীন কালথেকেই গ্রাম অঞ্চলে সংগীতের চর্চা হয়ে আসছে। গানের সৃষ্টিই করেছে গ্রামের চাষার ছেলে। চাষার হাত ধরেই এসেছে গানের ধারা। গান সাধারণ মানুষের সংগীত। এ সাধারণ মানুষের সংগীতকে লোকসংগীত বলা হয়। লোকসংগীতের দিক থেকে আমাদের দেশ বিশাল এক স্থান দখল করে আছে। কিন্তু আজ তা সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। লোকসংগীতের সমস্ত উপকরণ আমরা সংগ্রহ করেছি গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। গ্রাম অঞ্চলের এ লোকসংগীতের নানাবিধ উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

আমাদের দেশে লোকসংগীত গুলোর মধ্যে ভাটিয়ালি, বাউলগান, মাইজভাণ্ডারী, মারফতি, ভাওয়াইয়া, কবিগান, টপ্কা গান, বিচ্ছেদী ইত্যাদি গান। এক এক অঞ্চলে এক এক গান নিজস্ব আকার ইঙ্গিত নিয়ে বিরাজমান। যেমন ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া অঞ্চলে বাউলগানের ধারা প্রবাহমান। এ অঞ্চল যে শুধু বাউল গানের দিকে থেকে সমৃদ্ধ তা নয়, অন্যান্য লোকসংগীতের ধারাও পরিলক্ষ্যিত হয়। আবার রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরা গান বিখ্যাত। এসব আঞ্চলিক গানের মধ্যে নারীরাও সৃষ্টি করেছে তাদের নানাবিধ সৃষ্টিশীল শিল্প কর্ম। তারা পুরুষদের পাশাপাশি নানাবিধ ভূমিকা রেখে চলেছে। নারীদের দ্বারা সৃষ্ট সংগীতকে গীত বলা হয়। এ গীত ও আমাদের লোকসংগীতের অন্য এক ধারা। যা প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। এ দেশের মানুষের মন শীতল, কোমল। এদেশের মাটি তাদের তৈরি করে চলেছে সংগীত সাধক, কবি, লেখক, নাট্যকার, শিল্পী। এদেশের কৃষকেরা মাঠে ধান উৎপাদন করে, ধান উৎপাদন ছাড়া যেমন আমরা জীবন ধারণ করতে পারি না। তেমনই গান ছাড়া আমরা আমাদের মনের আবেগ উল্লাস প্রকাশ করতে পারি না। তাই তো গ্রামের তেমাথায় কোন এক বট বৃক্ষ তলে গানের আসরে শুনেছিলাম :
গানের দেশ, ধানের দেশ
আমার সোনার বাংলাদেশ
ফুলের দেশ, ফলের দেশ
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।

 লেখক : কবি 

  • গান
  • ভাষা
  • মানুষ
  • মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।