‘গুলিবিদ্ধ ২ মেয়ের পা কেটে ফেলতে বলেছিলেন শেখ হাসিনা’

Featured Image
PC Timer Logo
Main Logo

র‌্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলিতে আহত দুই মেয়ে মুমতাহিনা নাজ ও আয়শা খাতুন। ছবি: বাংলানিউজবিডিহাব

ঢাকা: গত বছরের ১৯ জুলাই, দিনটি ছিল শুক্রবার। জুম্মার নামাজের পর মোহাম্মদপুর থেকে বসিলা ব্রিজ পর্যন্ত সড়কে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। তাদের বিক্ষোভের মূল দাবি ছিল- বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দাবি মেনে না নিয়ে সারাদেশে যেভাবে গুলি করে মানুষ হত্যা চলছে- তা বন্ধ করা এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা।

কিন্তু সেদিন র‌্যাব, পুলিশ, এপিবিএন, সেনাবাহিনী, বিজিবি এমনকি এসএসএফ সদস্যরাও আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল ছুড়েছে; এমনকি গুলিও চালিয়েছে- বলে অভিযোগ করেছেন বসিলা এলাকায় বসবাসকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেদিনের নৃশংসতার বর্ণনা তুলে ধরেন বাংলানিউজবিডিহাবর কাছে। তুলে ধরেন র‌্যাবের হেলিকপ্টার থেকে আক্রমণে নিজের ঘরে দুই মেয়ের পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার নির্মমতার কথা। দুই মেয়ের মধ্যে একজন শ্যালিকার সন্তান। বাবা মারা যাওয়ায় ছোটবেলা থেকেই মাসহ খালার বাসাতেই থাকছেন। এক বাসাতেই বড় হওয়ায় দুজনকেই মেয়ের মতোই দেখেন মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ। তার নিজের মেয়ে মুমতাহিনা নাজ (১৮)। ভিকারুন নিসা নুন কলেজ বেইলি রোড শাখা থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল। শ্যালিকার মেয়ে আয়শা খাতুন (১১)। সে ভিকারুন নিসা নুন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি বসিলায় তার নিজ বাসায় দুই মেয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া নিয়ে কথা বলছিলেন তিনি। র‌্যাব-২ প্রধান কার্যালয়ের কাছেই তার বাসা। বাসার সামনে একটি খালি প্লট রয়েছে। এখানে বিকেলে এলাকার কিশোররা ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে থাকে। তার বাসার ছাদ থেকে বসিলা সড়কের পুরোটা এবং র‌্যাব কার্যালয় দেখা যায়।

কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সেদিন বিকেল ৪টার দিকে চারদিক থেকে শুধু গুলির শব্দ আসছিল। সবাই আতঙ্কিত। ঘরের বাইরে থেকে তেমন কেউ বের হচ্ছিল না। ছাদে গিয়ে দেখি, র‌্যাব কার্যালয়ের ছাদ থেকে চারদিক লক্ষ্য করে এক নাগারে গুলি করা হচ্ছে। আকাশে র‌্যাবের হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। বসিলা সড়কে একের পর এক বাহিনী এসে একনাগারে গুলি করছে। কে বিক্ষোভকারী, আর কে পথচারী, কাউকে বাদ দিচ্ছে না। সবাইকে গুলি করছে। পরে জানতে পারি তারা ছিলেন এপিবিএন ও এসএসএফ এর সদস্য। র‌্যাব ও পুলিশকে গুলি চালাতে দেখেছি। অনেক মরদেহ রাস্তায় পড়ে ছিল। কে নেবে কার খবর। এলাকার অনেকে মরদেহ এনে চুপ করে কবর দিয়েছে। ভয়ে কাউকে কোনো কিছুই জানায়নি।’

তিনি বলেন, ‘ওই দিন আমার বাসার সামনের খালি মাঠে অনেক কিশোর খেলছিল। আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা বারান্দা ও জানালা দিয়ে ওই খেলা দেখছিল। হঠাৎ র‌্যাবের হেলিকপ্টারটি বাসার সামনে এসে নিচে নামে এবং গুলি করতে করতে উপরে উঠে যায়। এ সময় একটি গুলি আমার বাসার এক রুমে দাঁড়িয়ে থাকা দুই মেয়ের পায়ে লাগে। একই গুলি এক মেয়ের পা ভেদ করে গিয়ে আরেক মেয়ের পায়ে বিদ্ধ হয়। হেলিকপ্টার উপরে ওঠার সময় আরও একটি গুলি নয় তলার ছাদে থাকা সোলার প্যানেল ভেদ করে বেরিয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে এলাকার কেউ বাইরে বের হতে পারছে না। অন্যদিকে বাসার ভেতরেও কেউ নিরাপত্তায় থাকতে পারছে না। ফলে প্রতিটি বাসায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে র‌্যাবের হেলিকপ্টার ও কার্যালয়ের ছাদ থেকে মুর্হুমুহু গুলিবর্ষণ তো চলছেই। চারদিকে ভূতুরে পরিবেশ। গুলিবিদ্ধ দুই মেয়েকে নিয়ে পড়ে যাই বিপাকে। ঘর থেকে বের হতে পারছি না। সড়কে রিকশা পর্যন্ত নেই।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘যতগুলো অ্যাম্বুলেন্স কল করেছি কেউ আসতে চায় না। দুয়েকজন আসতে চাইলেও কাছাকাছি দুরত্বে এসে বলে আর আসতে দিচ্ছে না। পুলিশ ও ছাত্ররা চেক করছে। যেতে দিচ্ছে না। ৯৯৯ কল করা হলে তারা একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিলেও পুলিশ বেড়িবাঁধে আটকে দেয়। দুই মেয়ের পা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। সবশেষ মুগদা হাসপাতাল থেকে একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স আসতে রাজি হয়। তবে বেড়িবাঁধে এসে আর আসতে পারবে না বলে জানায়।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স চালককে বলা হয়, আপনি গাবতলী হয়ে আমিন বাজার দিয়ে হেমায়েতপুরের বামে ঢুকে কেরাণীগঞ্জের তারানগর-আটিবাজার হয়ে বসিলা পার হন। তিনি তাই করেন। তারপরও বসিলা ব্রিজে শিক্ষার্থীরা সেটি আটকে দেয়। তবে গুলিবিদ্ধের কথা শোনার পর তারা ছেড়ে দেয়। সবশেষ অ্যাম্বুলেন্সে করে দুই মেয়েকে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাই। এ জন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিয়েছে ৪০ হাজার টাকা নিয়েছে। সব মিলে সেদিন রাতে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়।’

ওইদিন রাতে পঙ্গু হাসপাতালের বীভৎসতার চিত্র তুলে ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ শত শত ছেলে মেয়ে। সবার চিৎকারে হাসপাতালে যেন কেয়ামতের চিত্র ফুটে উঠেছে। ডাক্তার নার্স থাকলেও কেউ এগিয়ে আসছে না। সবাই যে যেখানে পারে পড়ে আছে। কতজন মারা যাচ্ছে। রক্তের জন্য হাহাকার। স্বজনদের ছোটাছুটি। আবার অনেক আহতের কোনো স্বজন আসেনি। কোন পথচারী বা সহকর্মী এখানে কোনরকম রিকশা ভ্যানে রেখে গেছে। তাদের আহাজারি দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। আমি ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছি। সেদিনও এরকমটা চোখে পড়েনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা এসে মেরেছে। আর এবার আমার দেশের বাহিনী জনগণকে মেরেছে।’

তিনি বলেন, ‘পরদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতালে আসেন। আমার দুই মেয়েকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখলেন। একটু পরে একজন নার্সের মাধ্যমে জানতে পারি, ডাক্তারকে শেখ হাসিনা গোপনীয়ভাবে বলে যান, যে করেই হোক দুই মেয়ের পা যেন কেটে ফেলা হয়। এ খবর পাওয়ার পর আমার পরিচিত এক চিকিৎসক সবাইকে এ কথা বলে যান যে, এই দুই মেয়ের চিকিৎসা তাকে না জানিয়ে যেন করা না হয়। এর গুলি বের করা হলে এক সপ্তাহ মেয়েকে দিন রাত পালা করে ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিয়েছি।’

আক্ষেপ করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘সরকারের পতন হয়েছে। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছে। সামনে কোন দল সরকার গঠন করবে জানি না। আন্দোলনে অনেক হতাহত আর্থিক সহায়তা পেলেও আমাদের খোঁজ কেউ করেনি। এলাকার একজন বিএনপি নেতা এসে ২০ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। আর কেউ খোঁজ করেনি। আহতের তালিকায় সম্ভবত নাম উঠেছে বলে শুনেছি। তবে এখনো কেউ যোগাযোগ করেনি।’

‘কী কারণে শেখ হাসিনা দুই মেয়ের পা কেটে ফেলতে বললেন, আপনার কী মনে হয়’- এর জবাবে তিনি বলেন, ‘পা কেটে ফেললে হয়তো দুই মেয়ের ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে রাজনীতি করতে পারতেন। কিন্তু সেটি করতে পারেননি।’

ওইদিন বসিলা ওয়েস্ট ধানমন্ডি গার্ডেন সিটির ওই বাসার ছাদে ছিলেন কেয়ারটেকার আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে হেলিকপ্টারটি এসে একটু নিচে নেমে আবার উড়াল দিল। এ সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়ছিল একজন। একটি গুলি সোলার প্যানেলে লাগলো। দৌড়ে নিচে নামলাম। নেমে দেখি কান্নাকাটি ও আর চিৎকার চেঁচামেচি। পরে দেখি দুই মেয়ের পায়ে গুলি লেগেছে।’

র‌্যাবের হেলিকপ্টার থেকে সেদিনের গুলিবর্ষণের ঘটনার সত্যতা বসিলা এলাকার একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজবিডিহাবর এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।

ঘটনার সময় র‌্যাব-২ এর সিও (কমান্ডিং অফিসার) ছিলেন পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। যিনি জুলাই আন্দোলনের কিছুদিন আগে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার থেকে পদোন্নতি পেয়ে র‌্যাবে আসেন। এই আনোয়ার হোসেন নয়াপল্টন এলাকায় সাংবাদিকের গলা চেপে ধরেছিলেন। ওই ছবিটি আলোচিত হয়েছিল। গত ৫ আগস্টের পর তাকে র‌্যাব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

ওইদিনের ঘটনার বিষয়ে র‌্যাব-২ এর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বক্তব্য জানতে চাইলে কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ে যোগাযোগ করা হলেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

জুলাই গণহত্যা নিয়ে প্রকাশিত হওয়া জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নিহত ১৪০০ মানুষের মধ্যে ১১৮ জন শিশু ছিল। শিশুদের বিশেষ টার্গেট করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, যাতে আতঙ্ক চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। প্রতিবেদনে উঠে আসে, যারা আহত হয়েছিলেন তাদের চিকিৎসা নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স আটকানো হয়েছে। হাসপাতালের বেড থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি করার মাধ্যমে ছাত্র নেতাদের সিস্টেমেটিক উপায়ে তুলে নেওয়া হয়েছে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে।

বাংলানিউজবিডিহাব/ইউজে/আরএস

১৯ জুলাই ২০২৪
বসিলা হত্যাকাণ্ড
মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদের বয়ান

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।