
ছবি : বাঁয়ে মো. শাওন, ডানে জামাল উদ্দিন আকবর বাবলা
সদ্যনিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের পুরান ঢাকার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রসন্ন পোদ্দার লেন ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন মো. শাওন ওরফে শাওন মুফতি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাতে তার মৃত্যুর প্রায় ১০ মাস পর গত ২৮ মে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। সেখানে আসামি হিসেবে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের ৫৭ নেতার নাম রয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০০-১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন আকবর বাবলার নামও রয়েছে। যিনি শাওনের মৃত্যুর সাড়ে চার মাস আগে ২০২৪ সালের ১৬ মার্চ মারা যান।
এদিকে শাওন সেই রাতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পুলিশের ছোড়া গুলিতে মারা যান বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। তবে মামলায় বলা হয়েছে, রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন। তখন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও তাদের সহযোগী সন্ত্রাসীদের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। যদিও মৃত্যু সনদে গুলির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদার সমকালকে বলেন, প্রজ্ঞাপনে শহীদ হিসেবে শাওন মুফতির নাম রয়েছে। তাকে হত্যার ঘটনায় করা মামলাটির তদন্ত চলছে। কোনো অসংগতি থাকলে তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তাঁতীবাজারের প্রসন্ন পোদ্দার লেনের ভাড়া বাসায় থেকে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতেন মাকসুদা বেগম। তার ২৩ বছর বয়সী ছেলে শাওন ইসলামপুরের একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। ঘটনার রাতে তিনি আন্দোলনে অংশ নিয়ে তাঁতীবাজার মোড়ের ‘ফুলকলি’ দোকানের সামনে বুকের বাম পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। এর দুই ঘণ্টা পর রাত দেড়টায় তাকে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়নি। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে ছেলের লাশ পান মাকসুদা। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পূর্ব দরিয়াপুরে লাশ দাফন করা হয়।
মাকসুদা বেগম গণমাধ্যমকে জানান, ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় তিনি মামলা করতে চাননি। পরে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে মামলা করার পরামর্শ দেন। নইলে তিনি কোনো সরকারি সহায়তা পাবেন না বলে জানানো হয়। তবে তাকে বলা হয়েছিল, পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। তিনি শুধু একটি কাগজে স্বাক্ষর দিয়েছেন। তিনজন আসামির নাম দিয়েছেন তিনি। তারা হলেন শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও স্থানীয় আয়না বিক্রেতা মো. শাহজালাল। তাদের মধ্যে শাহজালালের সঙ্গে তার বিরোধ ছিল, এজন্যই নাম দিয়েছেন (যদিও মামলায় এই নামে কোনো আসামি নেই)। বাকি আসামিদের তিনি চেনেন না। জামাল উদ্দিন আকবর বাবলা কে এবং তিনি মারা গেছেন এসব তার জানা নেই।
বাবলার ভাগনে হুমায়ুন কবির জানান, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর কলকাতার একটি হাসপাতালে ওপেন হার্ট সার্জারি হয় তার মামার। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। সেদিন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক শোকবার্তায়ও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
এদিকে শাওন ছাত্রলীগ করতেন বলে জানা নেই তার পরিবারের। নিহতের বোন মারিয়া আক্তার বলেন, এলাকার কেউ ডাকলে হয়তো মিছিলে গিয়ে থাকতে পারে শাওন। তবে সেভাবে রাজনীতিতে জড়িত ছিল না। আবার সব খবর তো মা-বোনের কাছে আসেও না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর অনুমোদিত প্রসন্ন পোদ্দার লেন ইউনিট ছাত্রলীগের কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে শাওনের নাম রয়েছে। সংগঠনের একাধিক নেতা শাওনের ছবি দেখে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সংগঠনের ৭৬ বছর উপলক্ষে বের করা মিছিলে ব্যানারের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় তার ছবিও পাওয়া গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সমকালকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানে আহত-নিহতের ঘটনা ঘিরে কিছু মামলায় ব্যক্তিগত ক্ষোভ, রাজনৈতিক শত্রুতা বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অনেককে আসামি করা হয়েছে। ভুক্তভোগীর রাজনৈতিক-সামাজিক পরিচয় যাই হোক না কেন, হতাহতের প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের বিচার করতে হবে। তবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা সাজানো হলে ভুক্তভোগীর বিচার পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, প্রকৃত ঘটনা একরকম, মামলায় বর্ণনা আরেক রকম, পরিবার বলছে অন্যরকম– এমন মামলা হলে সেগুলোর আইনগত ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। বিচারিক পর্যায়ে হয়তো মামলাগুলো টিকবে না।
সূত্র : সমকাল