সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:২৯
ঢাকা: টাকার জোগান দিতেই ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ সবসময় পপুলার ডিমান্ডে করা যায় না। ভ্যাট বাড়িয়েছি, সেটা নিয়ে বহু কথাবার্তা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিছু কিছু ভুল তো হয়। কিছু কিছু আড়ালে চলে যায়। অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন- সব ট্যাক্স কমিয়ে দেন, ভ্যাট কমিয়ে দেন। রাজস্ব বাড়ান। অনেকে বলেন- আমরা এতোগুলো কথা বললাম, এই অর্থ উপদেষ্টা কিছুই তো বাস্তবায়ন করছে না। বাস্তবায়ন যে হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়।
রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) সচিবালয়ে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বিএসআরএফের সাধারণ সম্পাদক মাসউদুল হক মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন। সভাপতিত্বে করেন সংগঠনের সভাপতি ফসিহ উদ্দীন মাহতাব।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমাদের রিসোর্স গ্যাপ অনেক বেশি। সব ভ্যাট যদি কমিয়ে দেই, তাহলে সরকারের আয় কোথায়? এজন্য আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবির সহায়তা নিতে হয়। তাদের ঋণ শোধ করতে হয়। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা গুরুতর আহত তাদের প্রত্যেককে ৩৫ লাখ টাকা করে কয়েকশ কোটি টাকা দিতে হয়েছে। পুলিশের ৩০০ গাড়ি পুড়িয়েছে, সেখানে ৫০০ কোটি টাকা দিতে হবে। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা আছে, রাজনৈতিক ব্যাপার আছে। তাহলে কীভাবে আমরা রাজস্ব ব্যয় কমাবো। এ টাকা আমি কোথা থেকে পাবো। টাকার জোগান দিতেই ভ্যাট বাড়িয়েছি। তবে অনেকগুলোতে ভ্যাট কমিয়েও দিয়েছি।
তিনি বলেন, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে অর্থ আনতে অর্থনীতির কতগুলো শর্ত মানতে হয়। আমরা কখনো শর্তে ফেল করিনি। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছে। তারা বলেন, ‘ভ্যাট বাড়াও’, ভ্যাট বাড়িয়ে এখন নানান রকম বিপত্তি হয়েছে। এগুলো খুব সেনসিটিভ, এক-দুই টাকা বাড়ানো মানে প্রবাসীদের জন্য নয়, আমাদের এখানে আমদানিকারক আছেন, নানা রকম অবলিগেশন আছে, যা কিছু আমদানি করছে সেগুলোর দাম বেড়ে যাবে।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, এটা সত্য যে, আমরা অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক সরকারের মতো শক্তিশালী না। এ কারণে আমরা অনেক চাপের মধ্যে আছি। ১০০টা চাপের মধ্যে আমরা ১০টা মানি। এই যেমন- রেলওয়ের ডিমান্ড, ওভারটাইম দাও, দিলাম। এরপর বলে লিমিট উঠিয়ে দাও, সেটাও উঠিয়ে দিলাম। কয়েকদিন পর বলবে, চাকরি থাকবে না বেতন দাও? তখন আমি কী করবো? সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি। অন্যদিকে প্রতিদিন যেভাবে রাস্তাঘাট আটকে রাখা হচ্ছে, এতে যদি মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, তখন দোকানদাররা দোষ দেওয়া শুরু করবে।
ভ্যাট বাড়ানোর পর চপ্পলের দাম বেড়েছে, সেটা নিয়ে কিছু মেয়ে প্রতিবাদ করেছেন। সে বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সস্তা চপ্পলে যদি ভ্যাট থাকে সেটা আমি রিভিউ করবো। যেমন ২০০ টাকা দামের ওপরে বিস্কুটে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এইচএস কোড থাকে, সেখানে অনেকগুলো পণ্য থাকে। সেখানে যদি চপ্পল থাকে তাহলে একটু সমস্যা।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের প্রবাসীরা ব্যবসা করতে চান না। তবে ব্যবসা করা কঠিন। সব কিছু তো আমরা করে দেবো না। সরকারের আয়-ব্যয়ে ব্যালেন্স করতে হয়। সেটা সবসময় যুক্তিসঙ্গত হবে তা কিন্তু নয়। ট্যাক্সের ক্ষেত্রে আপনি দেবেন, লাভবান আপনি হবেন। আমরা চাই একেবারেই সাধারণ মানুষ যেন লাভবান হয়। এখন শিক্ষকদের অনেক ডিমান্ড আছে, সেটা আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবো।
বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে চার-পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বিদেশে যায়? নেপাল, ইন্দোনেশিয়া বা ভারতের কেউ এত টাকা দিয়ে বিদেশ যায় না। এত বেশি টাকা লাগার মূল কারণ যারা এজেন্ট তারা বেশিরভাগ টাকা নিয়ে নেয়। ভাড়ার টাকা এত বেশি হওয়ার কথা না। বিদেশে যেখানে পাঠায় সেখানেও টাকার ভাগিদার আছে।
তিনি আরও বলেন, বেতন-ভাতা যা পায়, তা কিন্তু আশানুরূপ নয়। এর মূল কারণ হলো বেশিরভাগ অদক্ষ। আমি কয়েকদিন আগে মদিনা থেকে এলাম। দুয়েকটা হোটেলের ম্যানেজার বাঙালি, বেশিরভাগ ক্লিনার। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কান, ভারতীয় বা পাকিস্তানিদের বেশিরভাগ ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার অথবা ডেস্কে বসে। তফাতটা হলো তারা মোটামুটি লেখাপড়া জানা এবং ভাষাটাও ভালো জানে। আমাদের এখন দক্ষ জনবল বিদেশে পাঠানোর সময় এসেছে।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, আমরা ক্ষুরের ওপর দিয়ে হাঁটছি। চেষ্টা করছি, বলবো না যে, আমরা খুব ভালো করছি। অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমরা খারাপ নেই। আমরা মোটামুটি ভালো আছি। কিছুদিন আগে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ ছিল। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ ছিল। আমাদের রপ্তানি গ্রোথও নেগেটিভ ছিল। এখন কারেন্ট অ্যাকাউন্ট, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট পজেটিভ। মোটামুটি ম্যাক্রো ইকোনমিক স্ট্যাবিলিটি আছে। একেবারে পুরোপুরি চলে আসছে সেটা বলবো না।
তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে এখন আস্থা আসছে। বিদেশ থেকে অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে না পাঠিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাচ্ছে। সবই ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে তা বলবো না। হুন্ডির মাধ্যমে এলে সব টাকা দেশে আসে না। কারণ, ওটা বাইরেই থেকে যায়। বহু মানুষ আছে ডলার রেখে দেয়, আপনার টাকা পাঠায়। একটা ম্যাসেজ দিলো, হুন্ডা নিয়ে চট করে টাকা দিয়ে চলে যায়। কিন্তু আসার কথা ডলার। সেটা না আসার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রভাব পড়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারে দায়িত্বপালন প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, জনগণের এখতিয়ার মানে রাজনৈতিক সাপোর্ট, আমরা কিন্তু ক্ষমতায় আসিনি, আমাদের দেওয়া হয়েছে। আমরা যেটা করছি, কিছু কিছু কারণ আছে, সবকিছু ভেবেচিন্তে করছি। আমরা চেষ্টা করছি, ব্যর্থতাও আছে। সব কিছু আমরা কন্টিনিউ করতে পারবো না, সব সংস্কার করতে পারবো না। আমরা একটা ফুটপ্রিন্ট রেখে যেতে চাই। ফুটপ্রিন্ট মানে আমরা যেটা করছি, লোকজন কনভিন্স, যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা যেন এটা কন্টিনিউ করেন। যারা আসবেন তাদের রেসপনসিভ হতে হবে। অবশ্যই আমরা একটা কল্যাণমুখী, সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র করার চেষ্টা করছি। তবে সেটা অনেক দূরে, সেটা পলিটিক্যাল সরকার করবে।
বাংলানিউজবিডিহাব/আরএস