বাংলাদেশে হাঁপানির কারণে প্রতিবছর ৬ লাখ ৭০ হাজার রোগী জরুরি বিভাগে ভর্তি হয়ে বার্ষিক ২৬৩ মিলিয়ন কর্মদিবস হারিয়েছে। ৯ লাখ অকাল প্রসব এবং বার্ষিক ৭ লাখ কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। এসব স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে বিরাট অর্থনৈতিক ব্যয় জড়িত। যার মধ্যে উচ্চতর স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস অন্তর্ভুক্ত।
২০১৯ সালে সার্বিকভাবে এই ব্যয়গুলো ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। যা বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ।
শনিবার (১৮ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবে সিআরইএ ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে `বাংলাদেশে সূক্ষ্মকণা বায়ু দূষণে জনস্বাস্থ্য প্রভাব‘ শীর্ষক আলোচনায় এই গবেষণা প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের প্রভাবে (বার্ষিক গড় পিএম ২.৫) প্রতিবছর বাংলাদেশে ৫ হাজার ২৫৮ শিশুসহ ১ লাখ ২৪৫৬ জন মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়া বায়ু দূষণের কারণে হার্ট ডিজিস, স্ট্রোক, হাপানি-শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ফুসফুস ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
সিআরইএ এর গবেষণা বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দূষিত দেশের তালিকায় স্থান পায়। যেখানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বালু কণার বার্ষিক মান (পিএম ২.৫) ৭৯.৯ মাইক্রোগ্রাম।
যা বার্ষিক জাতীয় মানদণ্ড ৩৫ মাইক্রোগ্রামের দ্বিগুণের বেশি। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড ৫ মাইক্রোগ্রামের ১৫ গুণ বেশি। বায়ুর এমন চরম দূষণ জনস্বাস্থ্যের ওপর অনিবার্য পরিণতি ডেকে আনছে।বিভিন্ন বয়সীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হবার পাশাপাশি ৫ বছর কম বয়সী শিশুদের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
এছাড়া ডব্লিউএইচও-এর ২০২১ সালের কঠোর নির্দেশিকা বায়ুর মান প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা সম্ভব হলে মৃত্যুহার ৭৯ শতাংশ হ্রাস পাবে।
যা প্রতি বছর ৮১ হাজার ২৮২ মানুষের জীবন রক্ষা করবে। সেইসাথে হাপানি-শ্বাসকষ্ট প্রায় সমস্ত জরুরি চিকিৎসক ভিজিট, অকাল প্রসব এবং বার্ষিক ২৬৩ মিলিয়ন অসুস্থতাজনিত ছুটি এড়ানো যাবে।
এসময় ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য প্রধান শহরগুলোতে বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়। যা কার্যকর রাষ্ট্রীয় নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। পাশাপাশি, একটি ইন্টারেক্টিভ ড্যাশবোর্ড চালু করা হয়, যা সকল অংশীজনদের শহর ও জেলার ভিত্তিতে রিয়েল-টাইম দূষণের তথ্য এবং এর সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্যের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ প্রদান করে। যাতে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণের প্রভাবে উদ্বেগজনক স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যে, ২০২২ সালে সরকার প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধুলি কণার মান ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। যা গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টির পাশাপাশি বায়ুর মান অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
সিআরইসিএ-এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় বায়ু মানের মানদণ্ড (৩৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার) পূরণ করা সম্ভব হলে তা বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এতে মৃত্যুহার ১৯% হ্রাস, আয়ুষ্কাল জনিত সমস্যা (ওয়াইএলএল) ২১% এবং অক্ষমতার সাথে বসবাস করা বছর (ওয়াইএলডি) ১২% হ্রাস করতে পারে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে নিজস্ব জাতীয় নির্দেশিকা মেনে চলার পাশাপাশি তা প্রয়োগ করতে হবে। মাঝারি মেয়াদে ২০০৫ সালে ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হিসেবে ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা উচিত।
কয়লা ও ডিজেলের মত কার্বণ নিঃসরণকারী জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসাহিত করা উচিত। এছাড়া ক্লিন পরিবহন ব্যবস্থা ও শিল্প সম্প্রসারণ দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কঠোর শিল্প নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যানবাহন এবং কলকারখানার নির্গমন মান বাড়াতে হবে। ভূমিভিত্তিক এবং স্যাটেলাইট ডেটা একত্রিত করে জাতীয় পর্যবেক্ষণ কাঠামো তৈরি করতে হবে, স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ধারণে সহায়ক হবে।
সিআরইএ এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্লেষক এবং প্রধান লেখক ড্যানিয়েল নেসান বলেছেন, বিভিন্ন বায়ু মানের মানদণ্ড, বাংলাদেশের বর্তমান মান এবং ২০০৫ ও ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা তুলনা করে দেখা গেছে যে, পিএম ২.৫ স্তরে সামান্য উন্নতিও জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সুবিধা এনে দিতে পারে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি গ্রহণের মাধ্যমে বায়ু দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
সিআরইএ এর বায়ু মান বিশ্লেষক ড. জেমি কেলি বলেন, বাংলাদেশের বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার অপরিণত শিশু, কম ওজনের শিশুর জন্ম এবং শিশু মৃত্যু ঘটছে। এই পরিস্থিতি এমন হস্তক্ষেপের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, যা সবচেয়ে অরক্ষিতদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম। দূষণ প্রতি বছর প্রায় ২৬৬ মিলিয়ন কর্মদিবসের ক্ষতি সৃষ্টি করে, যা উৎপাদনশীলতার বড় ধরনের ক্ষতি করে ব্যবসা ও পরিবারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশের বায়ু দূষণ সমস্যার সমাধান জনস্বাস্থ্য এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের সমতুল্য।
ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বর্তমানে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা শুধু মানুষের শরীরেই প্রভাব ফেলছে না, বরং বিপর্যস্ত করে তুলছে মানসিক স্বাস্থ্যকেও। এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৪ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মানুষের গড় আয়ু ২ দশমিক ৭ বছর হ্রাস পেয়েছে। তবে উক্ত প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে নাগরিকদের গড় আয়ু হ্রাস পেয়েছে ৪ দশমিক ৮ বছর।