শুধু চোরাকারবারি আর পাচারে সীমাবদ্ধ নয় উপকূল আর সীমান্ত এলাকা সুন্দরবন। এখানে বসাবসকারী জনপদের মানুষের জনজীবন এখন দিনের পর দিন মাদকসক্তে জড়িয়ে পড়ছে। আর মাদককারবারিদের মূল টার্গেট স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণদের। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কৈখালী ইউনিয়ন ও রমজাননগর ইউনিয়নের সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সীমান্তসংলগ্ন কয়েকটি অংশকে নিরাপদ রুট (যাত্রাপথ) হিসেবে বেছে নিয়েছে চোরাকারবারিরা। এর মধ্যে সুন্দরবন তাদের জন্য অভয়াশ্রম।
গ্রাম হতে ফুঁসলিয়ে এনে প্রথমে ধর্ষণ, তারপরে দালালের মাধ্যমে ভারতে বিক্রি করা হয় এ রুট দিয়ে। স্থানীয়দের তথ্যমতে, প্রশাসনের সহায়তায় এই রুট ব্যবহার করে তারা ভারত থেকে অবৈধভাবে গরু, মাদকসহ নানা পণ্য আনছে যেমন, ঠিকই তেমনি বাংলাদেশ হতে জন্মনিয়ন্ত্রক পিল ও নারী-শিশু পাচার বেড়েই চলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মাঝে মধ্যে দু-চারটি চালান আটক হলেও মূলহোতারা থাকে ধরা ছোঁয়ার-বাইরে। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর জনপদের এ অংশটি এখন চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে।
অভিযোগ উঠেছে, সুন্দরবনসংলগ্ন সীমান্তপথে চোরাচালানের বিষয়টি খুবই সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠপর্যায়ে কর্মরতদের অনেকেই বিষয়টি জানেন। তারপরও নিয়ন্ত্রণ দূরের কথা অজ্ঞাত কারণে দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে, চোরাচালান পণ্যের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অধিকাংশ সময় বাঁধছে সংঘর্ষ। সুন্দরবনসংলগ্ন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী কৈখালীর পাঁচ নদীর মোহনা,ভদ্রখালী,শৈলখালী,কাটামারী, নিদয়া, নৈকাটি, রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চী, গোলাখালী, টেংরাখালীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার স্থানীয়দের পাশাপাশি চোরাকারবারিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বর্তমানে রাজনীতির পটপরিবর্তন ও দুই বাংলার সম্পর্কে টানাপোড়েনে ভারতের বিএসএফ ও বাংলাদেশ বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে নুরনগর, কৈখালী স্থলভাগ দিয়ে চোরাচালানের সুযোগ কম, ঝুঁকিও বেশি। তাই সীমান্তবর্তী কালিন্দীনদী ও রায়মঙ্গল নদীকে মাদক ও নারী পাচারকারীরা চোরাচালানের ‘মূল পয়েন্ট’ হিসেবে বেছে নিয়েছে।
সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল কৈখালীর স্থানীয় পেশায় জেলে-বাওয়ালী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েজন বলেন, বনদস্যুদের উপদ্রব না থাকায় সুন্দরবনের নৌপথ চোরাচালানের জন্য নিরাপদ। এছাড়া এ রুটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহলেরও ভয় থাকে না। এ সুযোগে নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে, ভারতীয় গরু ও মাদকসহ নানা পণ্য নির্বিঘ্নে বাংলাদেশে ঢুকছে। একইভাবে বাংলাদেশ থেকে ওষুধসহ নানা পণ্য ভারতে পাচার হচ্ছে।
রমজাননগর ও কৈখালী ইউনিয়নের চোরাচালানের মালামাল পরিবহনে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ভারতীয় চোরাকারবারিরা গরু ও মাদকের চালান কচুখালী, বকচরা, তালপট্রি ও হোগলডুরি এলাকায় রেখে যায়। বড় চালান রায়মঙ্গল এবং ছোট চালান কালিন্দি নদী সংলগ্ন পাঁচ নদীর মোহনা দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে যায়। স্থানীয় চোরাচালান চক্রের সদস্যরা মাছ বা কাঁকড়া শিকারের অজুহাতে স্পট থেকে সেই চালান সংগ্রহ করে। সুবিধাজনক সময়ে সেগুলো কৈখালীর দক্ষিণ কৈখালী আদম পাড়া,পশ্চিম কৈখালীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কার সিদ্দিক গাজীর বাড়িসংলগ্ন ও টেংরাখালী স্লুইসগেট, আলম চেয়ারম্যান ও আব্দুর রহমানের বাড়ি ছাড়াও গোলাখালী, কালিঞ্চি এবং পশ্চিম কৈখালী বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা দিয়ে পাচার করে। এর আগে ভারতের শমসেরনগর, কালিতলা, ঘুমটে ও গোবন্দকাঠি থেকে মাদকের বস্তা এবং গরু নৌকায় উঠিয়ে দেওয়া হয়।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে চোরাকারবারিতে জড়িত কয়েকজন জানান, পাঁচ নদীর মোহনা থেকে কিছুটা দূরত্বে বনবিভাগের কৈখালী স্টেশন, রায়নগর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি ও কৈখালী বিজিবি ক্যাম্প। এই অংশ দিয়ে চোরাচালানে ঝুঁকি রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই তারা চোরাচালানের কাজ করছেন। এ কাজ নির্বিঘ্ন করতে তারা ‘লাইন ম্যান’ (বাধাহীনভাবে মালামাল পরিবহন)’ দেয়। তাদের গরু প্রতি পাঁচশ থেকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয় বলে জানান।
এ বিষয়ে বিজিবি কৈখালী ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার বলেন, এমন অনৈতিক কাজের সঙ্গে বিজিবির কোনো সদস্য জড়িত আছে এমন অভিযোগ এখন পর্যন্ত কেউ করেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ইনচার্জ মোল্ল্যা হুমায়ুন কবির বলেন,শ্যামনগর থানা পুলিশ দিনরাত ২৪ ঘণ্টা জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি মাদক, চোরাকারবারি, মানবপাচার প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত। এছাড়াও সুন্দরবন-সীমান্ত এলাকা নজরদারির জন্য বিজিবি, নৌ-পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী কাজ করছে। এ বিষয়ে নানা ধরনের অভিযোগ শোনা গেলেও সরাসরি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না। সঠিক তথ্য ও নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করব।