নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে নাতিদীর্ঘ একটি লেখা ত্র ভেরিফায়েড ফেসবুকে গতকাল পোস্ট করেছেন। তার লেখাটি যথাসময়.কম-এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল। তসলিমা নাসরিন লেখেন-‘আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। একাত্তরে আমার পরিবারের লোক মুক্তিযুদ্ধ করেছে, আমার পরিবার পাকিস্তানি আর্মি দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। আমি বাহাত্তরের সংবিধানে আস্থা রাখি। আমি শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বলে মানি। ধর্মনিরপেক্ষতায়, গণতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে, মানবাধিকারে, এবং নারীর সমানাধিকারে আমি বিশ্বাস করি।
আমি যতটা দেশকে ভালবাসি, আমি নিশ্চিত, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ, সিপিবি, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের অধিকাংশ সদস্যই ততটা ভালবাসে না। দেশকে ভালবাসি বলেই দেশের মানুষকে সভ্য শিক্ষিত এবং সচেতন করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, নারীর সমানাধিকারের পক্ষে আমি লেখালেখি করেছি। বই প্রকাশ করেছি। কিন্তু ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, নারীবিদ্বেষী অপশক্তি আমাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছিল নব্বই দশকের শুরুতে, আমার পাশে তখন কোনও সরকার তো দাঁড়াননি, বরং উল্টে আমার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মামলা করে আমাকে চিরকালের জন্য নির্বাসন দণ্ড দিয়েছেন। এরপর না খালেদা জিয়া আমাকে দেশে ফিরতে দিয়েছেন, না হাসিনা দিয়েছেন। খালেদা, হাসিনা দুজনই মানবতার পক্ষে লেখা আমার বইও নিষিদ্ধ করেছেন।
গত জুলাইয়ে আমি কোটাবিরোধী আন্দোলনের সমালোচনা করেছি, কারণ আমি নারীকোটার পক্ষে। আমি চেয়েছি হাসিনা পদত্যাগ করুন, নতুন নির্বাচন দিন। কিন্তু দেশ থেকে তাঁকে বের করে দেওয়ার পক্ষপাতী আমি ছিলাম না। আমি কোনও দল করি না, কোনও দল ভাল করলে তার ভাল বলি, খারাপ করলে তার খারাপ বলি। তবে ধর্মভিত্তিক যে কোনও দলের আমি বিরোধী। আমি মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাসী হয়েও ধর্মের রাজনীতির ঘোর বিরোধী। জামায়াতে ইসলামিকে কোনও রাজনৈতিক দল হিসেবে আমি মানি না। ধর্ম আর রাজনীতি বা ধর্ম আর রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ পৃথক করা সভ্যতার প্রথম শর্ত বলে আমি বিশ্বাস করি।
হাসিনার অসংখ্য ভাল কাজের আমি প্রশংসা করি। কিন্তু তারঁ কিছু খারাপ কাজের সমালোচনা করি। খারাপ কাজের মধ্যে আছে ওলামা লীগ গঠন করা, হেফাজতকে মাদ্রাসা করার জন্য জমি আর অর্থদান করা, ৫৬০ মডেল মসজিদ করা, কওমী মাদ্রাসা গড়া, মাদ্রাসার ডিগ্রি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিকে সমমানের করা, সিলেবাসের ইসলামীকরণ করা, সংখ্যালঘু হিন্দু বৌদ্ধদের যথেষ্ট নিরাপত্তা না দেওয়া, সম্পূর্ণ বাকস্বাধীনতা এবং প্রেসফ্রিডম না দেওয়া, হাজার কোটি টাকা লুট করে যে আওয়ামী দুর্নীতিবাজরা পালাচ্ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন না দেওয়া ইত্যাদি। আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন প্রচুর লোক ছিল যারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার জন্য লীগে যোগ দিয়েছিল, অবশ্যই আমি তাদের বিরোধী। আমি ধিক্কার জানাই সেই আওয়ামী লীগারদের, যারা দেশে থাকা সত্ত্বেও ছুটে এসে জি *হাদিদের হাত থেকে রক্ষা করেনি শেখ মুজিবের ভাস্কর্য, যখন ভাস্কর্যের মাথায় উঠে জি *হাদিরা প্রস্রাব করছিল, আর শাবল কুড়োল দিয়ে শুধু একটি নয়, তাঁর সবগুলো ভাস্কর্য ভেঙ্গেছিল, যখন বুলডোজার এনে শেখ মুজিবের বাড়ি ভেঙ্গেছিল, স্বাধীনতা জাদুঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল।
যে আওয়ামী লীগাররা এখন জুলাই আন্দোলনে ছিল না বলে গর্ব করছে আর হাসিনার পদত্যাগ বা পতন যারা চেয়েছিল, তাদের নানাভাবে হেনস্থা করছে, বলতে চাইছে যে হাসিনার পতন হয়েছিল বলে জি *হাদি সরকার এসেছে ক্ষমতায়, তাদের বলতে চাই যে, হাসিনা অতি মাত্রায় জি *হাদি তৈরিতে সাহায্য করেছিল বলেই জি *হাদিতে দেশ ভরে গেছে। আর জি *হাদিরা যত ইসলামে বিশ্বাস করেছে, তত নারীবিদ্বেষী হয়েছে, যত নারীবিদ্বেষী হয়েছে তত বিশ্বাস করেছে নারী নেতৃত্ব হারাম। দেশ ইসলামে ভরপুর হয়ে উঠলে নারী আর নেত্রী হতে পারে না, নারীকে ঘরে ফিরে যেতে হয়, ফিরে গিয়ে স্বামী এবং সন্তান- সেবায় ব্যস্ত হতে হয়, ঘর থেকে দু’পা বেরোলে বোরখা নিকাব পরে বেরোতে হয়। শিক্ষা, সচেতনতা আর স্বনির্ভরতাও নারীর জন্য হারাম হয়ে ওঠে। হাসিনা দূরদর্শী ছিলেন না, তাই ইসলামকে কোলের ওপর বসিয়েছিলেন, কওমী মাতা সেজেছিলেন। হাসিনা-পতনের আন্দোলনের নেপথ্য নায়করা সবাই ছিল হাসিনার সাহায্য-সহযোগিতায় গড়ে ওঠা মাদ্রাসা থেকে পয়দা হওয়া জ *ঙ্গি। ইউনুস এই জ *ঙ্গিদের সর্দার হয়েছেন, কিন্তু এই জ *ঙ্গিদের পয়দা তিনি করেননি।
এখন যে আওয়ামী লীগাররা ভাবছে, ইউনুসকে হঠিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনবে, তারাই হাসিনার পদত্যাগ যারা চেয়েছিল তাদের সবচেয়ে বেশি হেনস্থা করছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে ইউনুস সরকার। জামায়াতে ইসলামী ছাড়া কোনও রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ জেতে, আমি খুশি হব। তবে ভোটে জিতে আসা চাই। বছরের পর বছর ক্ষমতার জোরে বিনা নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা কোনও ভাবেই ভাল কাজ নয়। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে নির্বাচনে যেতে ভয় তো লাগবেই। জনগণ থেকে কোনও নেতা নেত্রী যেন বিচ্ছিন্ন না হন। একবার ক্ষমতা হাতে পেলে অনন্ত কাল ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে যেন কেউ বিভোর না থাকেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে যেভাবে ইউনুসের জ *ঙ্গি বাহিনী নির্যাতন করছে, খুন করছে, জেলে ভরছে, পেটাচ্ছে –-তার প্রতিবাদ, আমি, দেশে আজ তিরিশ বছর নেই, কোনওদিন ফিরতেও কেউ দেবে না আমাকে, জেনেও, সামান্যতম স্বার্থ নেই আমার, বুঝেও, আওয়ামী লীগের লোক না হয়েও যেভাবে করেছি, সেভাবে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সদস্যই করেনি। ইউনুস সরকারের যত তীব্র সমালোচনা আমি করছি, তত তীব্র সমালোচনা অধিকাংশ আওয়ামী লীগারকে করতে দেখছি না। তাদের অনেকেই ওত পেতে আছে কখন বিক্ষোভ,প্রতিবাদ, আর সমালোচনায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে এই সরকার বিদেয় নেবে আর হাসিনা ফিরে আসবেন, আর তখনই চলবে তাদের লুটপাট,বিদেশে পালানো, হিন্দুর জমি দখল, দেশ জুড়ে জি *হাদি জ *ঙ্গি তৈরির কারখানা মসজিদ মাদ্রাসা বানানো। আমি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নই। আমি মনে করি আওয়ামী লীগকে শুদ্ধ হতে হবে, সৎ হতে হবে,দেশকে ভালবাসতে হবে, ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের মধ্যে রাখতে হবে, রাষ্ট্র এবং সমাজকে ধর্ম থেকে মুক্ত করা শিখতে হবে। একটা সময় তো এমন হয়েছে, কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, সত্য এই যে, জামায়াতে ইসলামি বা হেফাজতে ইসলামির সঙ্গে আওয়ামী লীগের আদর্শগত কোনও পার্থক্য ছিল না।
আওয়ামী নেতাদের চেয়ে এখন বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানই বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা বেশি জানাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনিই বেশি আপসহীন বক্তব্য রাখছেন, তিনিই ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। আসলে দল দেখলে এখন চলবে না। কোনও দলেরই কোনও আদর্শ আর নেই। স্বার্থের জন্য সব আদর্শ বিকিয়ে দিয়েছে সবাই। দল এবং দলের বাইরে কিছু শুধু মানুষ আছে এখনও খাঁটি, এখনও নিঃস্বার্থ। এই মানুষগুলো এক হোক, জোট বাঁধুক। দেশের এই দুরবস্থায় তাদেরই বেশি প্রয়োজন। দলান্ধ, আর স্বার্থান্ধে দেশ ছেয়ে গেছে। এখন হায়েনার মতো হিংস্র জি *হাদিরা দেশকে চিবিয়ে খাচ্ছে। দেশ এবং দশের ভাল এই খিলাফতিরা কোনওদিন চায়নি। দেশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে একবার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিবেকবান যুক্তিবাদী মানুষেরা গর্জে উঠুক।’