স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:৫১ | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:৫৯
ঢাকা: তিস্তা চুক্তি ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলার ১১টি পয়েন্টে টানা ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচি শুরু হয়েছে সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে। ‘তিস্তা নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি’র ব্যানারে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও অংশগ্রহণ রয়েছে।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাও’ কর্মসূচি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে এ কর্মসূচি, কী আছে সেই মহাপরিকল্পনায়? এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষই বা কারা? কাদের কাছে দাবি জানাচ্ছে আন্দোলনকারীরা। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে একটি পেছন ফিরে দেখতে হবে।
প্রায় ২৪০ বছরের পুরোনো নদী তিস্তা। এর সঙ্গে রয়েছে উত্তরের ২৫টি নদীর প্রবাহ। গত ২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকার একতরফা তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীটি একেবারেই শুকিয়ে যায়। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার রাজাহাট, উলিপুর, চিলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা। তবে শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই তিস্তা নদীবেষ্টিত। নদী শাসন না হওয়ায় গত পাঁচ বছরে গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী। কিন্তু, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে প্রতিবেশি দেশ ভারত। তাদের পানি নীতির কারণে শুস্ক মৌসুমে তিস্তা পাড়ের মানুষ পানি সংকটে পড়ে। আবার বর্ষাকালে বাঁধ খুলে দেওয়ায় ভয়াবহ বন্যার শিকার হয় রংপুর বিভাগের অন্তত পাঁচটি জেলার লাখ লাখ মানুষ। তাই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিটা জরুরি ছিল। কিন্তু, অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলে যাওয়ার পর তিস্তা নদীকে ঘিরে উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ দেখায় চীন। অতঃপর ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। মহাপরিকল্পনায় পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিগত সরকার চীনের সেই প্রস্তাবনার আলোকেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের প্রস্তাবিত এই ‘তিস্তা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বাড়বে। বন্যার পানি প্লাবিত হয়ে ভাসাবে না গ্রামগঞ্জের জনপদ। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা যাবে। এতে আছে- ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুপাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষি জমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন। নৌবন্দর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে প্রকল্পে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর, নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি সেচ ব্যবস্থা, মাছ চাষ প্রকল্প, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বিগত সরকার। চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও শেষ করেছিল। তিস্তা নদী পাড়ের জেলা নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় চায়নার তিনটি প্রতিনিধি সফর করেছিল।
প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ, বাঁধের দুই পাশে সমুদ্রসৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী, পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী। এসব বিষয় মাথায় রেখে তিস্তা পাড়ের পাঁচ জেলার মানুষ দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চায়। মানুষের এই চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ আন্দোলন শুরু করেছে।
বাংলানিউজবিডিহাব/এজেড/পিটিএম