
বিশ্বকবি একটি উপাধি কিন্তু সাহিত্যে মহীরুহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এই উপাধি ঠিক পরিপূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করতে পারে না। কারণ এটি আদতে কবির কবিত্ব শক্তিকে প্রকাশ করছে, কবিত্বকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করছে কিন্তু একজন পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রনাথ যিনি একইসাথে কবি, ছোট ও বড় গল্পকার, ওপৌন্যাসিক, নাট্যকার, অভিনেতা, চিত্রশিল্পী এবং আরও বহুগুণে অধিকারী সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উপস্থাপন করে না। একটি বিশালাকার বৃক্ষের নিচে যেমন মানুষ নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয়, সাহিত্যও রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় এসে নিশ্চিন্তে বিকশিত হয়েছিল। এই পোড়ার দেশে রবীন্দ্রনাথকে সম্ভবত সবচেয়ে কট্টর সমালোচনা সহ্য করতে হয়। অথচ এই সত্যটুকু কেন স্বীকার করা হয় না যে রবীন্দ্রনাথবিহীন বাংলা সাহিত্য প্রায় শূন্য। রবীন্দ্রপরবর্তী যুগেও বহু বছর রবীন্দ্রচর্চা করা হয়েছে মানে কবিগুরুর ধারাই অনুসরণ করা হয়েছে।
কোনো যুগের শুরু হঠাৎই হয় না। সব কবির জন্যই হয় না। কিন্তু রবীন্দ্র যুগ তো শুরু হয়েছে। এবং শেষও হয়েছে। তবে সম্পূর্ণরুপে হয়নি। সেটা কোনো কালেও সম্ভন না। যুগে যুগে রবীন্দ্রনাথ আসবেন, থাকবেন এবং ছায়া দিয়ে যাবেন সে আমরা যতই রবীন্দ্রশক্তিকে অস্বীকার করতে চাই না কেন। যদি রবীন্দ্র যুগ আমরা কেটে-ছেঁটে ফেলে দিই তাহলে বাংলা সাহিত্য হবে অপূর্ণ। বাংলাভাষা এবং সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাশ্চাত্য অনেক দেশের বোদ্ধামহল বাংলা সাহিত্য বলতে প্রথমে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই বুঝিয়ে থাকেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রিউমার হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন! অথচ যারা এই ট্যাগ জুড়ে দিচ্ছেন তারা কিন্তু কোনো তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেন না। যদিও বা করেন সেটা কোন প্রেক্ষিতে কেন বলেছিলেন সেটা পাওয়া যায় না। কারণ অনেক বক্তব্যই ঘুরেফিরে বহুরকমভাবে উপস্থাপিত হয়। কথার ধরন এবং উদ্দেশ্য এক থাকে না। এরকম কট্টর সমালোচনা আরও আরও আছে। এই সমালোচনা দ্বারা বড়জোড় আপনি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে দূরে ফেলতে পারবেন হয়তো কিন্তু তাঁর সাহিত্যকে অস্বীকার করার মতো ক্ষমতা নেই। এ আমি দৃঢ়ভাবেই বলছি। এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ কার্জন হলে দ্যা মিনিং অব আর্ট শিরোনামে বক্তৃতা রাখেন, ১৩ই ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় বক্তৃতার শিরোনাম ছিল দ্যা রুল অব জায়ান্ট। জগন্নাথ হলের ছাত্রদের অনুরোধে কবি লেখেন গীতিকবিতা ‘বাসন্তিকা’।
রবীন্দ্র সমালোচনায় হুমায়ুন আজাদ লেখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ- যাঁকে বাতিলের চেষ্টা করে আসছে নষ্টরা পবিত্র পাকিস্তানের কাল থেকে; পেরে ওঠে নি। এমনই প্রতিভা ঐ কবির, তাঁকে বেতার থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয় জুড়ে বাজেন; তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয়ের কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত হয়ে যান, তাঁকে বঙ্গভবন থেকে বাদ দেওয়া হলে তিনি সমগ্র বঙ্গদেশ দখল করেন; তাঁর একটি সঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে তিনি জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠেন।’ আমাদের স্বভাবই এমন যে সবাইকেই এক চোখে পরিমাপ করতে চাই। সমালোচনা করা তো দোষের কিছু না বরং যদি আমাদের মতো সামান্য জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক সিকি অংশ পাঠ না করে তার সাহিত্য নিয়ে সমালোচনা করি, কবির কোনো বক্তব্যকে সামান্য করে মানে কেটেকুটে তারই বিরুদ্ধে চালিয়ে দেই এবং শেষ অবধি জাতীয় সঙ্গীত বাতিলের বিষয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠেপড়ে লাগতে দেখি তখন মনে হয় কবিগুরুর সেই উক্তি- রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। আর সেই সুদূর পরবাসের কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস বলেছেন, আমি প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথ পড়ি তাঁর কবিতার একটা লাইনই জগতের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে। যারা ইয়েটসকে অস্বীকার করতে চান করতেই পারেন তাহলে পৃথিবীতে আর কেউ থাকে না! সত্যকে অস্বীকার করা চরম মূর্খামি! আমরা মাঝে মধ্যেই আবেগের বশবর্তী হয়ে এই মূর্খামি করে ফেলি। আমরা তো রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের তুলনা করেই ক্ষান্ত হই না, আমরা বিতর্ক জুড়ে দেই কে বড় কবি! কি আশ্চর্য স্পর্ধা আমাদের!
যে কাজ কবি দ্বয়ের জীবিত থাকা অবস্থায় হয়নি, তাদের অন্তর্ধানের পর সেই নিয়ে আমরা টানাটানি করছি! অথচ কবিতার ক্ষেত্র এবং অন্যান্য বিবেচনায় ঠাকুর বাড়ির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বন্দুক হাতে কাজী নজরুল ইসলাম স্ব স্ব ক্ষেত্রে শক্তিশালী এবং এই ক্ষেত্র মহিমাণি¦ত করেছেন। এখানে বাস্তবিক তুলনা করার কিছু নেই। আর কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সব সময় কাজী নজরুল ইসলামকে স্নেহই করেছেন। এই তুলনা আমাদের দুই মহান কবিকেই ছোট করে। কিভাবে একজন কবি থেকে রবীন্দ্রাথ ঠাকুর বিশ্বকবি হয়ে উঠলেন সে অনেক পথ। কর্বির কবিত্ব শক্তি কোনো পরিবারের তা ধনী বা দরিদ্র যাই হোক তার উপর নির্ভর করে না। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু সন্তান জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো দূরের কথা তার ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি। কারণ তখন শৈশব থেকেই জমিদারির নেশায় পেয়ে বসে, পয়সা খরচ করে তারা কবি পুষতে পারে কিন্তু কবিতা লেখা জমিদার হাতে গোণা। পদ্মার জলে ভাসতে ভাসতে কত জনের মনে আর কবিতার লাইন আসে! সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থবিত্ত কবির কবিত্ব শক্তি বৃদ্ধি করেছিল অনেক সমালোচকের এ ধরনের সমালোচনা অবান্তর মাত্র। তবে এ কথা সত্যি যে পরবর্তীতে কবি কবিতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছিল তার পরিবারের বিত্ত। এই সুবিধাটুকু সকলেই পায় না অথবা পায় নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেকে সাধকও বলেছেন। একজন একনিষ্ঠ সাহিত্য সাধক। জমিদার পরিবারে বড় হয়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বকবি হয়ে ওঠার সময়কালে নিজে এই বাঙালি সমাজের কাছে এক বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর লেখার মোহমায়ায় তৎকালীন বাঙালি সমাজকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়।
এখনও কিন্তু সেই আলোড়ন সমাপ্ত হয়নি। বরং রবীন্দ্রগবেষকগণ প্রতি নিয়তই তার বিষয়ে নতুন নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করছেন। আজও বাঙালি সমাজ বিশ্বকবির রেখে যাওয়া প্রেমের বাণীতেই মেতে আছেন। আজও গুণগুণ করে গানের কলিতে কবিগুরুর প্রেমের স্তুতি সাধনা করে। এই যে বাঙালিকে দেড় শতাধিক বছর ধরে মোহাবিষ্ট করে রেখেছেন সে কি আর এত সহজেই পেরেছেন? এখন প্রশ্ন হলে কবিগুরুর সাধনা করা প্রেম শারীরিক না মানসিক ছিল? এর উত্তর হতে পারে দুটোই ছিল তবে শরীরের চেয়ে মনের পরিতৃপ্ত অন্তরঙ্গ সাধনাই ছিল প্রধান। ঠিক এই জায়গাতেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তীব্র সমালোচনা রয়েছে। কবির সাথে তাঁর বৌদির সম্পর্ককে ইঙ্গিত করে বহু রটনা রয়েছে। এ কথা কেউ অস্বীকার করেননি যে এটা মিথ্যা। বরং ঠাকুরবাড়ির ভিতরকার এই অসম কাহিনী সত্যি। তবে ঠিক যতভাবে ছড়ানো হয়েছে সেভাবে সত্যি নয়। ভেবে দেখার বিষয় যে, ঠিক অতকাল আগে আমরা যেভাবে প্রেম দেখছি সেভাবে প্রেম করা সম্ভব ছিল কতটুকু? তাও আবার বাড়ির সকলের নজর এড়িয়ে! বৌদির সাথে সম্পর্ক নিয়ে ঠাকুরবাড়িতে গুঞ্জন ওঠার পরপরই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। যা হোক সে অন্য কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচনা হতেই পারে কিন্তু তাকে বার বার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, সীমারেখার লাইনে বিভক্ত করে সমালোচগণ কোনো শুভ বুদ্ধির পরিচয় দেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজনই। তিনিই বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক