
জীবন মানেই সংযম, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা, শান্তি। অসংযম মানে যম, অশান্তি। যম মানে মৃত্যু। মানবদেহের কু-প্রবৃদ্ধিগুলোকে দমন করে রাখাই হচ্ছে সংযম। সংযমকে পরিমিতি বোধও বলা যায়। আত্মসংযম হচ্ছে বড় সংযম। কাজে-কর্মে, কথা-বার্তায়, চিন্তা-চেতনায়, ভাবে-স্বভাবে, ভাষায়, খাদ্য-খানায়, পানাহারে- এক কথায় দৈনন্দিন জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিমিতি বোধ বা সংযমের প্রয়োজন। লালন দর্শনের পরতে পরতে রয়েছে মানব ইন্দ্রিয়ের সংযমের কথা।
মানবদেহ ইন্দ্রিয় দ্বারা পরিচালিত হয়। আর মানবদেহে রয়েছে ১৪টি ইন্দ্রিয়। ৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয় যথা- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা ও ত্বক। ৫টি কর্মেন্দ্রিয় যথা- বাক, হস্ত, পদ, পায়ু ও উপস্থ। ৪টি অন্তরিন্দ্রিয় যথা- মন, বুদ্ধি, অহঙ্কারও চিত্ত। মন হচ্ছে সকল ইন্দ্রিয়ের পরিচালক। মনের ইচ্ছায় অন্য ইন্দ্রিয়গুলো পরিচালিত হয়। মন হচ্ছে লোভী, পেটুক, ইন্দ্রিয় সুখে আসক্ত। মন শুধু চায় আর চায়। অনেক সময় দেহ পারে না তবুও মন চায়। মন চায় ধন-সম্পদ, অর্থ, নারী/পুরুষ, ক্ষমতা, শৌর্য-বীর্য। সে শুধু চায়ই না, অন্যকে বঞ্চিত করেও চায়। তখন লালন মনকে বাগে আনার কথা বলেছেন, মনের লাগাম টেনে ধরার কথা বলেছেন। সে যেন বেপরোয়া না হয়ে যায়। তাই লালন ইন্দ্রিয়ের পরিচালক মনকে বলছেন-
মন আমার গেল জানা
কারো রবে না এ ধন জীবন যৌবন
তবে কেন মন এত বাসনা।
একবার সবুরের দেশে বয় দেখি দম কষে
উঠিস নারে ভেসে পেয়ে যন্ত্রণা।।
লালন ইন্দ্রিয় পরিচালক মনের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন যে, জান-মাল-ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী নয় তা নিয়ে এত বাসনা কেন? কিন্তু মন তা বুঝতে চায় না। সে শুধু কুপথে গমণ করতে চায়। মন নিয়ে লালন পড়েছেন দায়। তাই তিনি আক্ষেপ করে বলছেন-
মনেরে আর বুঝাব কত
যে পথে মরণফাঁসি সেই পথে মন সদাই রত।।
কিছু মানুষের স্বভাব আল ঠেলা (জমির সীমানা ঠেলা), পর স্ত্রীর দিকে ধাবিত হওয়া। পর দ্রব্য, পর নারীতে যার লোভ বৃদ্ধ বয়সেও সে তা সংবরণ করতে পারে না। দেহের সক্ষমতা নেই তারপরে মনে সাধ জাগে। তার মন ভালো না। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে তার সাধন-ভজন সবই বৃথা। লালন সাঁইজি বলেন-
মন এখনো সাধ আছে আল ঠেলা বলে।
চুল পেকে হয়েছে হুড়ো চামড়া বুড়োর ঝুলমুলে।।
হেঁটে যেতে হাঁটু নড়বড়ায় তবু যেতে সাধ মন বারোপাড়ায়
ঢেংড়ার সুমার বুদ্ধি তোমার ভুচ কুয়ারা জানলে।।
কথায় বলে, কয়লা ধু’লে ময়লা যায় না, স্বভাব যায় না ম’লে। বুড়ো হয়েছে, চুল পেকেছে, হাঁটু নড়েবড়ে, পা চলে না তারপরেও মন বারোমহল্লায় যেতে চায়, স্বাদ গ্রহণ করতে চায়। তখন লালন মনকে সবুরের দেশে যেতে বলেছেন মানে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন। মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মনের দোষে মানুষ দোষী হয়, বিপদে পড়ে, ইহকাল-পরকাল উভয়কালে মর্যাদা হারায়, সহজানন্দ, সদানন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। লালন বলেন-
কারে দিব দোষ নাহি পরের দোষ
মনের দোষে আমি পড়লাম রে ফেরে।
আমার মন যদি বুঝিত লোভের দেশ ছাড়িত
লয়ে যেত আমায় বিরজা পারে।।
মনের গুণে কেহ হল মহাজন,
বেপার করে পেল অমূল্য রতন,
আমারে ডুবালি অবোধ মন
এখন পারের সম্বল কিছুই না পেলাম করে।।
লালন মতে, মনের দোষে কেউ দোষী। আবার মনের গুণে কেউ মহাজন। তিনি আক্ষেপ করে বলছেন, মন যদি বুঝত লোভের দেশ ছাড়ত, নিয়ে যেত বিরজা পারে। বিরজা পারে মানে সদানন্দ, সহজ মানুষের বাস যেখানে। মনকে বশে আনতে না পারলে মানুষ অমূল্য রতন হারায়, অতল সাগরে ডুবে মরে। তাই মনকে বশে আনাই সাধকের বড় কাজ। মনকে কিভাবে বশে আনতে হবে সে পথও লালন বাতলে দেন। দম কষে মানে দমকে নিয়ন্ত্রণ করে তথায় ডুবে থাকতে হবে। তথায় যন্ত্রণা পেলেও ভেসে উঠা যাবে না মানে মনকে নিয়ন্ত্রনহীন করা যাবে না বা লোভ-লালসায় গা ভাসিয়ে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন-
সাধুসঙ্গ কর রে মন অনর্থ হবে বিবর্তন
ব্রহ্মজ্ঞান ইন্দ্রিয় দমন হবে রে সঙ্গগুণে।।
কথায় বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। লালনও মনে করেন, সাধুসঙ্গ নিলে জীবন হবে ধন্য। সাধু হচ্ছে পরিশুদ্ধ মানুষ। ইন্দ্রিয় সুখ চায়, ভোগে আসক্ত থাকতে চায়। এসব থেকে নিস্তার পেতে দরকার সাধুসঙ্গ। সাধুসঙ্গে ইন্দ্রিয় দমন হবে, চিত্তে ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হবে। সাধুসঙ্গ ব্যতীত জীবন হবে অনর্থ, খালি হাতে ফিরতে হবে। [এখানে বিবর্তন প্রত্যাবর্তন, ফিরে আসা অর্থে ব্যক্ত হয়েছে।] কুসঙ্গে মুক্তি নেই, মিত্র নেই, আছে শত্রু। লালন বলেন- যা বলে ভবে আসা হলো না তার রতিমাসা/কুসঙ্গে উঠাবসা তাইতে মনের মূল হারায়।
মানবজীবন হচ্ছে শত্রু পরিবেষ্টিত জীবন। শত্রুর মধ্যেই মানবের বাস। লালন সাঁইজির মতে, মানুষের রয়েছে ষোলোজন শত্রু। ষোলোজন শত্রু বা ডাকাতের সঙ্গে মানবের বাস। ডাকাত দল জীবনকে করে তুলে অতিষ্ঠ, পাগলপ্রায়। লালন বলেন- শহরে ষোলোজনা বোম্বেটে/করিয়ে পাগলপারা নিল তারা সব লুটে।
ষোলোজন বোম্বেটে মানে ষোলোজন ডাকাত। তারা হচ্ছে ৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয় যথা- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা ও ত্বক। ৫টি কর্মেন্দ্রিয় যথা- বাক, হস্ত, পদ, পায়ু ও উপস্থ এবং ৬টি রিপু- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। এরা সব লুটে নেয়। এদেরকে বশীভূত করেই সাধু হতে হয়। এদেরকে বশীভূত করতে না পারলে পরিশুদ্ধ মানুষ হওয়া যায় না। লোভের বশীভূত হলে মুক্তি মিলে না। লালন বলেন- শিরনি খাওয়ার লোভ যার আছে/সে কি চেনে মানুষ রতন দরগাতলায় মন মজেছে।।
খাওয়ার লোভে যার মন মজে থাকে দরগাতলায় তার পক্ষে মানুষ রতন তথা পরম মানুষের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। শিরনি হচ্ছে পিরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত মিষ্টান্ন দ্রব্য বা ভোগবিশেষ। কিছু লোক আছে যারা খাবার লোভকে সংবরণ করতে পারে না। উপরে তাদের সাধুর বেশ ভেতরে তাদের লোভ-লালসা-দ্বেষ। লালন বলেন-ভিতরে লালসার থলি উপরে জল ঢালঢালি/লালন কয় মনমুছল্লি কেন হয় না তোর মনে।
কোনো আমানত খেয়ানত করা যাবে না। অর্থাৎ কোনো গচ্ছিত দ্রব্য আত্মসাৎ করা গর্হিত অপরাধ। ধার করলাম, পরিশোধ করলাম না এটা অন্যায়, বিবেক বর্জিত কাজ। এসব যারা করে তাদের পক্ষে ফানার ফিকির জানা সম্ভব নয়। আর ফানার ফিকির না জানলে তার পক্ষে ফকির হওয়াও সম্ভব নয়। আগে মনকে কষে ধরো, তারপরে করো ফকিরি। লালন বলেন- মনের নেংটি এটে কররে ফকিরি/আমানতের ঘরে মনা হয় না যেন চুরি।
যাতে আরাম তাতেই ব্যারাম। কামে যেমন আনন্দ আছে তেমনি নিরানন্দ আছে, পতন আছে, অযাচিত জন্ম আছে। তাই কামকে নিয়ন্ত্রণ করে অযাচিত জন্ম রোধ করে সহজানন্দ লাভের পথ বাতলে দিয়েছেন। লালন বলেন-
আগে কপাট মারো কামে ঘরে
মানুষ ঝলক দেবে রূপনিহারে।।
বারে বারে করি মানা লীলার দেশে বাস করো না
রেখো তেজের ঘর তেজিয়ানা উর্ধ্বচাঁদ ধরে।।
কামরিপু মনের প্রবৃত্তিগুলো উত্তেজিত করে প্রলুদ্ধ করতে, পথভ্রষ্ট করতে প্রচেষ্টা চালায়। কামরিপুকে দমন করে প্রবৃত্তিকে জয় করতে হবে। কামহীন প্রেম সাধন করতে হবে। আর তা করাই একজন সাধকের সাধনা। পর দ্রব্য পর নারী এই নিয়ে যত কাঁড়াকাঁড়ি- মারামারি। লালন বলেন, এই লোভ ছাড়ো। তা না হলে পারে যেতে পারবে না মানে মুক্তি পাবে না। লালন সাঁইজি বলেন- পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করো না/পারে যেতে পারবে না।
লালনের এ বাণীর মর্ম কথা হচ্ছে অন্যায় করে সত্য পথ, মুক্তির পথ জোটে না। এ জন্য সত্য ও সুপথে জীবনকে পরিচালিত করতে হবে। তবেই মিলবে মুক্তি। সত্য ও সুপথের আরাধনা বড় আরাধনা, বড় সাধনা। লালন বলেন- সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন/সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন।
সত্য মানে আলো। আলোকিত মানুষ হচ্ছে পরিশুদ্ধ মানুষ। একজন পরিশদ্সাধ মানুষ হচ্ছে একজন সাধু। আলো যেমন অন্ধকার দূরীভূত করে, সত্য তেমনি মিথ্যা দূরীভূত করে। মিথ্যা দূরীভূত হলেই মুক্তি মিলে, পরম মানুষের দেখা মিলে। এজন্য বলা হয়,Honesty is the best policy.
পরিশুদ্ধ, আলোকিত মানুষ হতে হলে দরকার ষোলো ডাকাতের সঙ্গত্যাগ। এদের সঙ্গ ত্যাগ করলে জীবিত মানুষ আর জীবিত থাকে না। হয়ে যেতে হয় জ্যান্ত মরা। অর্থাৎ জীবনে বিষয়-আশা, লোভ-লাসা, কামনা-বাসনা ত্যাগ করে মনের মানুষের অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকা। তবেই যায় শমনজ্বালা। কেননা মৃত্যু মানুষের আবার শত্রু কী? তবে এই মৃত্যু পার্থিব দেহের মৃত্যু নয়। জীবিত অবস্থায় ইন্দ্রিয় সত্তার মৃত্যু বা ইন্দ্রিয় সত্তাকে রুখে দেওয়া। লালন বলেন- মরার আগে ম’লে শমনজ্বালা ঘুচে যায়/লালনের আরেক গানে আছে,/হাওয়া ধর, অগ্নি স্থির করো যাতে মরে বাঁচিতে পারো/ মরণের আগে মরো শমন যাক দূরে।।
শমনজ্বালা ঘুচে গেলেই আলো ফুটে উঠে, অন্ধকার দূর হয়, মুক্তির দরজা খুলে যায়, নির্বাণ প্রাপ্তির পথ প্রশস্ত হয়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও সম্পাদক, এনসিটিবি