বাংলাদেশের রাজনীতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোগত সংকটের প্রকৃতি বিশ্লেষণে বাংলা কথাসাহিত্যের দুটি কালজয়ী উপন্যাস যথার্থ পথপ্রদর্শক। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লালসালু’ এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ শুধুমাত্র সাহিত্যিক অনন্যতা নয়, বরং আমাদের সমাজ ও রাজনীতির গভীর বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করেছে। ‘লালসালু’র মজিদ যেমন ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে লালসালুর প্রতীকী মোড়কে মাজারকেন্দ্রিক শক্তির উৎসকে ব্যবহার করে শোষণের মাধ্যমে ক্ষমতার বলয় তৈরি করেছিল, আমাদের রাজনীতিতেও প্রতিনিয়ত এর অনুরূপ চিত্র পরিলক্ষিত হয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা ছুতায় নিজ নিজ দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের মাজারে পুষ্প অর্পণ, প্রতিষ্ঠাতাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি ও তাদের বন্দনা এবং দলীয় প্রতীকের প্রতি প্রথাগত আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান সংহত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাই তো মৃত নেতার মাজার হয়ে ওঠে দলীয় শক্তির প্রতীকী পুঁজি। ব্যক্তিপূজা ও পারিবারিক আনুগত্যের এই ‘লালসালু’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে গোষ্ঠীগত স্বার্থ চরিতার্থ করার একটি বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই রাজনৈতিক নেতারা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে বা বাড়াতে প্রতীকী পুঁজি ও রাজনৈতিক নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্যের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেন।
এ প্রবণতা কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিকেই উসকে দেয় না, বরং জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ ম্যাক্স ওয়েবারের (১৮৬৪-১৯২০) ‘অনন্য ব্যক্তিত্বের কর্তৃত্ব’ (ক্যারিশম্যাটিক অথরিটি) ধারণার সাথেও সম্পর্কিত। ওয়েবার দেখিয়েছেন, ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্য একসময় প্রতিষ্ঠিত কাঠামোগত শোষণকে ন্যায্যতা দিতে পারে। লালসালুর মজিদ যেমন ধর্মীয় প্রতীকের আড়ালে শোষণের মঞ্চ তৈরি করেছিল, তেমনি দলীয় রাজনীতির নামে প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিত্বের বা তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য আমাদের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চর্চাকে প্রান্তিক করেছে। এই অন্ধ আনুগত্যের সংস্কৃতি জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে এবং রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহিতার জায়গায় শূন্যতা তৈরি করে। তাই এই সংকট নিরসনে প্রয়োজন শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে ক্ষমতায়িত করা, যা তাদেরকে কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্তি দিয়ে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতাপূর্ণ সামগ্রিক ও সামষ্ঠিক কল্যাণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর তত্ত্ব এখানকার প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ফুকো দেখিয়েছেন যে, ক্ষমতা সবসময় একটি জ্ঞান কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সেই জ্ঞানকে ব্যবহারের মাধ্যমে শাসন জারি থাকে। মজিদের অজ্ঞাত পীরের মাজার যেমন ধর্মীয় বিশ্বাসের জ্ঞানকে ব্যবহার করে জনগণকে শোষণ করেছিল, তেমনি রাজনৈতিক নেতারা আজ দলীয় প্রতিষ্ঠাতার মাজার, ছবি, ভাস্কার্য বা স্বাধীনতা যুদ্ধে বা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দলের প্রতিষ্ঠাতার অবদানকে প্রতীকী পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে জনমনে প্রভাব বিস্তার করছেন। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক সমাবেশে ঐতিহাসিক প্রতীকের ব্যবহার বা নির্দিষ্ট পরিবারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ জনগণের চিন্তার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে এবং তাদের প্রশ্ন করার সক্ষমতাকে দমন করে। এ ধরনের রাজনীতির ফলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে ওঠে ক্ষমতাকেন্দ্রিক, যেখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কমে যায় এবং গণতন্ত্রের মর্মমূল দুর্বল হয়। এই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য দরকার একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যা মানুষের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশ ঘটাবে। জন ডিউইর শিক্ষাতত্ত্বে বলা হয়েছে, শিক্ষা শুধু তথ্য সরবরাহ নয়, বরং তা মানুষকে চিন্তা করতে, প্রশ্ন করতে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা জাগ্রত করতে শেখায়। এই ধরনের সমালোচনামূলক শিক্ষা জনগণকে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর প্রতীকী পুঁজি ভিত্তিক শোষণ থেকে মুক্তি দিতে পারে এবং একটি অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে হোসেন মাঝির ময়না দ্বীপ এক ইউটোপিয়ান স্বপ্নের রূপক, যা বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়ানোর কোনো ভিত্তি পায়নি। হোসেন মাঝি তার অনুসারীদের এমন এক সুখের দ্বীপের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, যা কেবল আশা ও আকাঙ্ক্ষার উপর নির্মিত ছিল, কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য কোনো সুসংহত পরিকল্পনার অভাব ছিল স্পষ্ট। তার এই স্বপ্নের অনিশ্চয়তা সম্পর্কে সে নিজেও সচেতন ছিল। উপন্যাসের এই চিত্র বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক গভীর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। আজকের রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই ইউটোপিয়ান প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে জনগণের মন জয় করার চেষ্টা করে। দলীয় বক্তৃতা বা নির্বাচনী প্রচারণায় উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, এবং সমতা প্রতিষ্ঠার বর্ণনা দেওয়া হলেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের পরিকল্পনার অভাব জনগণের জন্য হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। ভোটারদের আস্থা অর্জনের জন্য অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে বাস্তবায়িত না হলে জনমনে একপ্রকার নিরাশার সঞ্চার করে।
সংগত কারণে আমাদের এ আলোচনায় ব্রিটিশ দার্শনিক থমাস হোবসের (১৫৮৮-১৬৭৯) ‘সমাজিক চুক্তি’ তত্ত্ব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তিনি দেখিয়েছিলেন, একটি সুশাসনব্যবস্থা তখনই কার্যকর হতে পারে, যখন এটি জনগণের স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও নীতিমালা গ্রহণ করবে। কিন্তু যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের ক্ষমতার বৈধতা জনকল্যাণের পরিবর্তে কেবল শাসনকেন্দ্রিক প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করে, তখন জনগণের আস্থা দুর্বল হতে বাধ্য। সুতরাং রাজনীতিতে ময়না দ্বীপের ইউটোপিয়ান কৌশল থেকে সরে এসে সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি। উন্নয়নমূলক প্রতিশ্রুতিগুলোকে কেবল স্বপ্নের মধ্যে আটকে না রেখে, সেগুলোর ভিত্তিতে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে, রাজনীতি জনগণের স্বপ্ন পূরণের বদলে তাদের হতাশার উৎসে পরিণত হবে।
হোবস আরো বলেছেন, মানুষের মধ্যে ক্ষমতার জন্য আকাঙ্ক্ষা চিরস্থায়ী। যদি সেই আকাক্সক্ষাকে পরিচালনা করার জন্য সুশাসনের কাঠামো না থাকে, তবে সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এই তত্ত্বেরই একটি প্রতিচ্ছবি। অবাস্তব ও অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে, অথচ বাস্তবায়নে ব্যর্থতা জনগণের আস্থা ক্রমাগত ক্ষয় করে। এ ধরনের রাজনীতির ফলে অরাজকতার একটি চক্র তৈরি হয়, যেখানে প্রত্যেকটি দল ক্ষমতা অর্জনের পর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি উদাসীন থাকে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন জনশিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে প্রতারণামূলক প্রতিশ্রুতি চিহ্নিত করতে সক্ষম করে তোলা। ব্রাজিলিয়ান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক পাউলো ফ্রেইরে (১৯২১-১৯৯৭) তাঁর ‘নিপীড়িতের শিক্ষা’ (পেডাগোগি অফ দ্য অপপ্রেসড) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, শিক্ষা মানুষের চেতনার মুক্তি ঘটায় এবং তাদেরকে শোষণকারী কাঠামোর বিরুদ্ধে সচেতন করে ও তা থেকে মুক্তির পথ দেখায়। শিক্ষার মাধ্যমে জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের ইউটোপিয়ান প্রতিশ্রুতি যাচাই করতে শিখতে পারে এবং বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা ও নেতৃত্বের দাবিতে সোচ্চার হতে পারে। সুতরাং একটি সুশিক্ষিত সমাজই পারে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি করতে।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও রাজনৈতিক দলগুলোতে গত ৫৩ বছরে গণতন্ত্রের বিকাশের পরিবর্তে আমরা লক্ষ্য করেছি ক্ষমতার ক্রমাগত কেন্দ্রীকরণ। দলীয় রাজনীতির নামে বিশেষ পরিবার ও তাদের সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিদের গোষ্ঠীগত আধিপত্যের কারণে দেশ ও দশের প্রকৃত স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। রাজনীতির উদ্দেশ্য যেখানে দেশের ও দশের সেবা হওয়া উচিত, সেখানে এটি হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীনদের নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ার। এখানে ইটালিয়ান মার্ক্সবাদী দার্শনিক ও ভাষাতাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামশির (১৮৯১-১৯৩৭) ‘আদিপত্য’ (হেজিমনি) ধারণা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। গ্রামশি দেখিয়েছেন, কিভাবে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী কেবলমাত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেজিমনির এই চর্চা স্পষ্ট। রাজনীতিকরা দলীয় প্রতীক, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসকে কৌশলে ব্যবহার করে জনগণের মানসিক জগতে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছেন। ফলস্বরূপ জনগণ একধরনের সাংস্কৃতিক অনুগত্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যেখানে তারা নিজ দলের শাসকদের শোষণমূলক আচরণের বিরুদ্ধেও নীরব থাকতে বাধ্য।
তবে এই হেজিমনির তথা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক দাসত্বের প্রভাবের চক্র থেকে জনগণকে মুক্ত করতে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আলজেরীয় বংশোদ্ভুত সংকর ফরাসি মনোবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক দার্শনিক ফ্রঁৎস ফানোঁ (১৯২৫-১৯৬১) তাঁর ‘যৌক্তিক জ্ঞান’ (রেশনাল নলেজ) তত্ত্বে দেখিয়েছেন, শোষিত জনগোষ্ঠীকে শাসনমুক্ত করতে প্রথম প্রয়োজন তাদের চেতনার মুক্তি। সমালোচনামূলক শিক্ষা জনগণকে শেখায় কিভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো বিশ্লেষণ করতে হয়, এবং কীভাবে ক্ষমতাসীনদের অযৌক্তিক আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যা গণতন্ত্রের মূল্যবোধ এবং জনস্বার্থ রক্ষার চেতনা জাগ্রত করতে সক্ষম। এটি কেবল জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনও আনবে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের মূলমন্ত্র হতে হবে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতিষ্ঠা এবং সৎ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের বিকাশ। আজ আমরা যে নেতৃত্ত্ব সংকটের মুখোমুখি, তার কারণ হলো জনকল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। রাজনীতি যদি জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার মাধ্যম না হয়, তবে তা কেবল শোষণ ও বৈষম্যকেই দীর্ঘস্থায়ী করবে। এক্ষেত্রে ইংরেজ দার্শনিক ও চিকিৎসক জন লকের (১৬৩২-১৭০৪)-এর ‘সামাজিক চুক্তি’ তত্ত্ব এবং ফরাসি দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী জ্যাঁ জ্যাক রুশোর (১৭১২-১৭৭৮) ‘জনপ্রভুত্ব’ তত্ত্ব আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারে। জন লক দেখিয়েছেন, শাসনব্যবস্থার বৈধতা আসে জনগণের সম্মতি থেকে এবং শাসকের মূল দায়িত্ব জনগণের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা। অন্যদিকে, রুশোর জনপ্রভুত্ব তত্ত্বের মূল কথা হলো, প্রকৃত গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয়, যখন জনগণ কেবল শাসিত নয়, বরং শাসনের অংশীদার হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই আলোচ্য তত্ত্বগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে, বংশপরম্পরা বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ইচ্ছায় নয়। একই সঙ্গে, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে সৎ ও দায়িত্বশীল চরিত্র গঠনের জন্য নৈতিক শিক্ষার প্রচলন জরুরি। অ্যারিস্টটল (খ্রিস্ট পূর্ব ৩৮৪-৩২২) বলেছেন, “রাজনীতি হলো নৈতিকতার বাস্তবায়নের মাধ্যম”। সুতরাং, নৈতিকতা যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে না থাকে, তবে প্রকৃত সুশাসন প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। এই সংকট উত্তরণে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন, সমালোচনামূলক চিন্তাশীল এবং অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল করতে হবে। গণমুখী রাজনীতির জন্য প্রয়োজন একটি শিক্ষিত সমাজ, যারা শাসকের প্রতিশ্রুতিকে যাচাই করবে এবং জবাবদিহিতার দাবি জানাবে। তাই, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনে শিক্ষা কেবল উপায় নয়, এটি হতে হবে মূল চালিকাশক্তি।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লালসালু’ এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ আমাদের দেশের রাজনীতির জন্য এক গভীরতর শিক্ষার উৎস। এই দুই সাহিত্যকর্ম কেবল গল্প বা মানুষের সম্পর্কের কাহিনী নয়; এগুলো শোষণমূলক প্রবণতা, অন্ধ বিশ্বাস, এবং অবাস্তব স্বপ্নের চর্চার বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। মজিদ যেমন ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল, তেমনি হোসেন মাঝি এক অবাস্তব ইউটোপিয়ায় তার অনুসারীদের বন্দি রেখেছিল। আধিপত্য চর্চার এই কৌশলগুলোর রাজনৈতিক প্রতিরূপ হলো ক্ষমতাসীনদের অবাস্তব প্রতিশ্রুতি এবং প্রতীকী পুঁজির শাসন, যা জাতীয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তৈরি করেছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে শাসকগোষ্ঠীকে বুঝতে হবে যে, শোষণমূলক নীতিমালা এবং অনৈতিক আচরণের মাধ্যমে কোনো সমাজ টেকসইভাবে এগোতে পারে না। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য সৎ, জবাবদিহিমূলক এবং গণমুখী নেতৃত্বের প্রয়োজন। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (১৯২৯-১৯৬৮) বলেছিলেন, ‘ন্যায়বিচারবিহীন শান্তি কখনো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।’ সুতরাং, রাজনীতিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব নয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতে জন-আকাঙ্খার বাস্তবায়নে আমাদের করণীয় হলো রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা প্রতিষ্ঠা করা, যা হবে জনকল্যাণমুখী নীতি ও নৈতিকতা-ভিত্তিক। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণ করতে হবে। এর সঙ্গে শিক্ষার, বিশেষ করে জনশিক্ষার, ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই কেবল তাদের শাসক দলের প্রতিশ্রুতি যাচাই করতে পারে এবং ন্যায়বিচারের দাবি জানাতে পারে। অমার্ত্য সেন (১৯৩৩-) তাঁর ‘মুক্তি হিসেব উন্নয়ন’ (ডেভলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম) গ্রন্থে বলেছেন, ‘শিক্ষা শুধু উন্নয়নের হাতিয়ার নয়; এটি মুক্তিরও পথ।’ তাই, শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা, সমালোচনামূলক চিন্তা শেখানো, এবং শোষণমূলক নীতিমালার বিরুদ্ধে সক্রিয় করতে হবে।
রাষ্ট্রসংস্কারের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলে গণতান্ত্রিক আবহ তৈরিতে বাংলাদেশে এখন সময় এসেছে শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার। এর জন্য প্রয়োজন একটি নৈতিক ও গণমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যা কেবল আমাদের সভা, সমিতি ও বক্তৃতা কিংবা সাহিত্য বা তত্ত্বে নয়, বরং আমাদের জাতীয় জীবনে বাস্তবায়িত হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি আজ একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি, যেখানে জনগণের আস্থা ক্রমশ ক্ষয়ে গেছে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লালসালু’ এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে কিভাবে শোষণমূলক প্রবণতা, অবাস্তব স্বপ্ন, এবং অন্ধ আনুগত্য সমাজকে বিভ্রান্ত করে। এই সাহিত্যের শিক্ষা আমাদের রাজনীতির প্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। শোষণ ও প্রতারণার রাজনীতি কোনোভাবেই টেকসই উন্নয়ন বা শান্তির পথ তৈরি করতে পারে না। বরং এটি ক্রমাগত একটি হতাশা ও অবিশ্বাসের দুষ্টচক্র তৈরি করে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে ও রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কারের। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা এবং নেতৃত্বে নৈতিকতার অনুশীলন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জনকল্যাণমুখী রাজনীতি কেবল সৎ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে পারে, অন্য কোনভাবে নয়। পাশাপাশি, জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। এজন্য শিক্ষা একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। একটি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীই কেবল শোষণের চক্র ভেঙে ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি সুশাসিত সমাজ গড়ে তুলতে পারে। তাই এখনই সময় সাহিত্য, ইতিহাস এবং তাত্ত্বিক শিক্ষার আলোকে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর জন-আকাঙ্ক্ষা রূপ দিতে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করার। শোষণমূলক প্রবণতা এবং অবাস্তব স্বপ্নের রাজনীতি থেকে সরে এসে এমন একটি সমাজ গড়তে হবে, যেখানে জনগণ কেবল শাসিত নয়, বরং শাসনের অংশীদার হয়। দেশ ও দশের কল্যাণের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতি যেমন জনগণের আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে, তেমনি একটি প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের পথকেও সুগম এবং গতিশীল করতে পারে।
লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য