শিক্ষকদের শিক্ষক হায়াত আলী মিঞা – BanglaNewsBDHub.com |

Featured Image
PC Timer Logo
Main Logo



ছবি : হায়াত আলী মিঞা ও লেখক স্বপ্নীল ফিরোজ

মানুষের মাঝে কিছু মানুষ তাদের কর্ম, আদর্শ  ও ত্যাগের কারণে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকেন। তেমনই জনাব হায়াত আলী মিঞা (৬জানুয়ারি ১৯৪৩-১৩ জুলাই ২০২১) তিনি ছিলেন- একাধারে একজন কিংবদন্তি শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সংস্কৃতিমনা সমাজকর্মী ও মানবিক রাজনীতিক। ১৩ জুলাই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই মহৎ মানুষটিকে, যিনি কেবল জয়পাড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন দুই প্রজন্মের আলোকবর্তিকা।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন : হায়াত আলী মিঞার শৈশব কেটেছে শিক্ষার প্রতি অসাধারণ অনুরাগ আর মানবিক মূল্যবোধে গড়ে ওঠা পরিবেশে। ছাত্রজীবনেই তিনি নেতৃত্বগুণে উজ্জ্বল ছিলেন। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতা হিসেবে রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য একজন ঘনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও মানবিক আদর্শই ছিল তাঁর সারাজীবনের অনুপ্রেরণা।

মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্ব : ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জনাব হায়াত আলী মিঞা মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার যুদ্ধকালীন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে সাহস যুগিয়েছেন এবং মাটি ও মানুষের লড়াইকে এগিয়ে নিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর দূরদর্শিতা ও নির্ভীক ভূমিকা সেই দুঃসময়ে অনেক তরুণকে যুদ্ধের ময়দানে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই অবদান ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

এক অনন্য শিক্ষা-সংস্কারক : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনাব হায়াত আলী মিঞা জয়পাড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং টানা ৪০ বছর নিষ্ঠা, দক্ষতা এবং মমতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর হাতে গড়ে ওঠে একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান নয়; বরং নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও মানবিকতার শিক্ষাও লালিত হত।

তিনি খেলাধুলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্কাউট আন্দোলনকে স্কুলের মূলধারায় নিয়ে আসেন। ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতির জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং ঢাকা জেলা স্কাউটস-এর সেক্রেটারি ও কমিশনার হিসেবে তাঁর অনন্য নেতৃত্বে দোহার-নবাবগঞ্জের ক্রীড়া ও স্কাউট আন্দোলন এক নবজাগরণের রূপ পায়।

তাঁর এক অকৃত্রিম মমতার গল্প আজও আমার মনে এক অবিস্মরণীয় সুখের পরশ হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে। জাতীয় পর্যায়ে জয়পাড়া পাইলট হাই স্কুলের ছাত্র হিসেবে আমি হাই জাম্পে স্বর্ণপদক জেতার গৌরব অর্জন করেছিলাম। স্যার আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন—

‘তুই আজ জয়পাড়া পাইলট হাই স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছিস। এ আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে- স্কুল আজ দুই পিরিয়ড ছুটি ঘোষণা করছি। সকলের উৎসাহ আর উদ্দীপনায় আমাদের স্কুল আরও সাফল্যের পথে এগিয়ে যাক।’

সেদিনই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, আমি স্কুলজীবনের বাকি সমস্ত ক্লাসে সম্মানিত ফুল ফ্রি স্টুডেন্ট হিসেবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব। একজন স্কুলছাত্রের জন্য প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া এমন স্বীকৃতি আর কী হতে পারে! সেদিন থেকে তিনি আমার মনের সবটুকু শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গা দখল করে আছেন এবং থাকবেন চিরকাল।

রাজনীতিতে অসামান্য ভূমিকা : মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনাব হায়াত আলী মিঞা দোহার থানা আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মণির আস্থাভাজন সহযোগী। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শনিষ্ঠ মানবিক রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

জয়পাড়া কলেজ প্রতিষ্ঠায় অবদান : ১৯৭২ সালে দোহার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী জয়পাড়া কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কলেজের গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে ক্লাসে স্বেচ্ছাশ্রমে বিনাবেতনে অধ্যাপনা- সবকিছুতেই তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর পরিচালনায় অনেক মেধাবী ছাত্র তৈরি হয়েছে, যারা পরবর্তীতে দেশে-বিদেশে গৌরবের সাথে বিভিন্ন পেশায় সাফল্যের সাক্ষর রেখে যাচ্ছেন।

ছাত্রদের গর্বের বাতিঘর : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হায়াত আলী মিঞার ছাত্ররা আজ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত—কেউ মন্ত্রী, কেউ সংসদ সদস্য, কেউ বিচারপতি, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কবি বা সাহিত্যিক। তাঁর শিষ্যরা আজও গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘স্যার আমাদের শুধু পড়াননি, মানুষ হতে শিখিয়েছেন।’

হায়াত আলী মিঞা স্যার ছিলেন বহুমাত্রিক মানুষ— একজন দেশপ্রেমিক শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজ সংস্কারক, ক্রীড়া সংগঠক এবং আদর্শ রাজনৈতিক নেতা। তাঁর শাসন যেমন ছিল দৃঢ়, তেমনি ছিল এক অকৃত্রিম স্নেহে ভরপুর। তিনি চলে গিয়েছেন, কিন্তু রেখে গেছেন হাজারো ছাত্র-ছাত্রীর মনে তাঁর শিক্ষা, আদর্শ আর ভালোবাসার অমলিন স্মৃতি। মৃত্যুর ওপারেও আপনার এই আলোকিত জীবন আমাদের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে। আপনার জন্য রইলো কোটি কোটি কৃতজ্ঞ হৃদয়ের দোয়া ও মাগফিরাতের প্রার্থনা। তাঁর জীবনে কোন ব্যর্থতার গল্প নেই। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন অসংখ্য গুণগ্রাহী, ৪ কন্যা এবং দুই পুত্র। তাঁর প্রতিটি সন্তানকে তিনি মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে গিয়েছেন। সমাজ ও রাস্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে তাঁরাও স্যারের দেখানো পথ ধরে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে-নিভৃতে।

লেখক : প্রবাস থেকে

  • আদর্শ
  • কর্ম
  • ত্যাগ
  • মানুষ
  • মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।