
মাদারীপুরে কুমার নদের পাশে শতবর্ষী একটি বটগাছ। লোকজন ধর্মীয় বিশ্বাসে গাছের গোড়ায় মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালাতেন। পাশাপাশি নতুন গামছা, কাপড়, মিষ্টি, নাড়ু, হাঁড়ি-পাতিলসহ নানা জিনিসপত্র রেখে যেতেন। এমনকি গাছের শিকড়, ডালপালা ও মাটি নিয়ে যেতেন। গত বৈশাখকে বটগাছের নিচে মেলা ও বাউল গানের আয়োজন করেন স্থানীয়রা। এতে বাধা দেন আলেম-ওলামারা। পাপ ও শিরকের অভিযোগ এনে গতকাল সোমবার শতবর্ষী গাছটি কেটে ফেলেন তাঁরা। ঘটনাটি ঘটেছে সদর উপজেলা শিরখাড়া ইউনিয়নের আলম মীরারকান্দি গ্রামে।
মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে যায়, গাছটির গোড়ার দিকের কিছু অংশ এখনো কাটা অবশিষ্ট আছে। তবে ইতিমধ্যে বেশির ভাগই কেটে ফেলা হয়েছে। খবর পেয়ে সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের লোকজন। এদিকে গাছ কাটার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তা নিয়ে চলছে নানা মন্তব্য।
স্থানীয়রা জানান, সদর উপজেলার সিরখাড়া ইউনিয়নের আলম মীরারকান্দি গ্রামের কুমার নদের পাশে স্থানীয় সাত্তার হাওলাদারের মালিকানাধীন একটি বাগানের মধ্যে শত বছরের একটি বটগাছ ছিল। কয়েক বছর ধরে গাছটিকে ঘিরে কিছু লোকজন নানা কর্মকাণ্ড করে আসছিলেন। তাঁরা মনের বাসনা পূরণ, রোগবালাই থেকে মুক্তি, সন্তান কামনাসহ নানা বিষয় নিয়ে মানত করতেন। গাছের গোড়ায় মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালাতেন। পাশাপাশি নতুন গামছা, কাপড়, মিষ্টি, নাড়ু, হাঁড়ি-পাতিলসহ নানা জিনিসপত্র রেখে যেতেন। এমনকি গাছের শিকড়, ডালপালা ও মাটি নিয়ে যেতেন।
সম্প্রতি বৈশাখকে ঘিরে শতবর্ষী এই বটগাছের নিচে মেলা ও বাউল গানের আয়োজন করেন স্থানীয়রা। এতে চোখে পড়ে স্থানীয় আলেম সমাজের। তাঁরা বাধা দিলে আর সেখানে বৈশাখের এই আয়োজন হয়নি।
তাঁরা আরও জানান, পাশের গ্রাম সদর উপজেলার চরঘুনসি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর সাত্তার হাওলাদারের মালিকানাধীন জায়গার গাছটি ১ হাজার ৫০০ টাকায় স্থানীয় আলেমরা কিনে নেন। গতকাল সকাল থেকে গাছটি কাটা শুরু করেন তাঁরা। গাছের বেশির ভাগ অংশ কাটা সম্পন্ন হলেও গোড়ালির কিছু অংশ বাকি থাকে।
এ ব্যাপারে কথা বলতে সাত্তার হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিক দেখে ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়েন এবং মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখেন।
গাছ কাটায় অংশ নেওয়া আব্দুল কুদ্দুস নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘গতকাল আমিও গাছ কাটায় অংশ নিয়েছি। এই গাছকে ঘিরে শিরক চলে। গাছের গোড়ায় মোমবাতি, নতুন কাপড়, মিষ্টি দেওয়া হয়। যা পাপ ও শিরক। আল্লাহ এগুলো মেনে নেবেন না। তাই শতাধিক আলেম ও জনতা মিলে গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা শারমিন বেগম বলেন, ‘আমি বিয়ের পর প্রায় ৩০ বছর ধরে এই গাছটি দেখে আসছি। কিন্তু সামান্য এই অজুহাত দিয়ে গাছটি কেটে ফেলা ঠিক হয়নি। এই গাছ কাটা বন্ধ করার জন্য অন্য ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু শত বছর বয়সী গাছটি কাটা ঠিক হয়নি।’
মো. মাহবুব হোসেন নামে আরেকজন বলেন, ‘গাছ আমাদের অনেক উপকারে আসে। নদী পার হয়ে এখানে বটগাছের ছায়ায় অনেক মানুষ বিশ্রাম নিত। পাপ ও শিরকের অজুহাত দিয়ে গাছটি কাটা ঠিক হয়নি। তবে এগুলো বন্ধের জন্য অন্য ব্যবস্থা নিতে পারতেন।’
জেলা খেলাফত মজলিসের সভাপতি মাওলানা হাবিব আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, বটগাছের গোড়ায় এমন কর্মকাণ্ড ইসলাম সমর্থন করে না। তাই কেটে ফেলা হয়েছে এই গাছটি।
শিরখাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান মো. বাবুল হোসেন বলেন, ‘এভাবে গাছটি না কেটে গাছটি বাঁচিয়ে রাখা উচিত ছিল। যদি কেউ গাছের গোড়ায় মিষ্টি বা নতুন কাপড় দান কিংবা মোমবাতি বিতরণ করে থাকে, তাহলে তাদের বোঝানো যেত। এভাবে পুরোনো একটি গাছ কেটে ফেলা উচিত হয়নি।’
মাদারীপুর বন বিভাগের জেলা বন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ঘটনাটি আমরা জানি। সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ব্যাপারটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। তারা যে সিদ্ধান্ত দেন, সেভাবে পরবর্তী কাজ করা হবে।’
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, ‘পুরোনো গাছ কেটে ফেলার খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এটির পেছনে তৃতীয় কোনো পক্ষ কাজ করছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া বন বিভাগ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার তদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’