সন্‌জীদা খাতুন : এক বাঙালি কিংবদন্তির মহাপ্রয়াণ – BanglaNewsBDHub.com |

Featured Image
PC Timer Logo
Main Logo



বাঙালি সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব, ছায়ানট’র সভাপতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সংগঠক ও শিক্ষক ড.সন্‌জীদা খাতুন (১৯৩৩-২০২৫) ছিলেন আমাদের সৃজনকলা ও মননশীলতার বাতিঘর। বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিক অখণ্ডতা বজায় রাখার লড়াইয়ে সম্মুখ সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দানের কারণে এদেশের মানুষের কাছে তিনি বোধিবৃক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬১-র রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ পালনের আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের নানা প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের মাধ্যমে রমনা-বটমূলে ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনার আলোকিত দীর্ঘযাত্রায় তিনি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে বাংলাদেশে শুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীত চর্চায় তাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

সন্‌জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্‌জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়েই তার কর্মজীবন শুরু। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন। ‘ষাট দশকে জাতির জাগরণের উত্তাল সময়ে ছায়ানট হয়ে ওঠে বাঙালির সাংস্কৃতিক যাত্রার দিশারী সংগঠন। আর স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রত্যাঘাতের সময় ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামেও ছায়ানট থাকল একই অবস্থানে অবিচল প্রত্যয়ে। গোড়ায় ছিলেন অনেকের একজন, ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর বাস্তবতায় যখন ছায়ানটের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বেড়েছে, এবং যখন জাগরণে ও প্রতিরোধে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনুঘটকের ভূমিকায় ছায়ানট তখন বা ততদিনে এ প্রতিষ্ঠানের কাণ্ডারি সন্‌জীদা খাতুন।’ (আবুল মোমেন, দৈনিক প্রথম আলো ‘ছুটির দিনে’, ২১ এপ্রিল, ২০১২) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সন্‌জীদা খাতুনের অবদান গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। ১৯৭১ সালের মার্চে তিনি রংপুরে অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ যখন জীবন বাঁচানোর তাড়নায় ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান- ঠিক সে সময় দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভেবে জীবন বাজি রেখে তিনি রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন। এরপর সাভারের জিরাবো গ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তার সাথে কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মীও ছিলেন। তারা ভারতের আগরতলা শহরে কিছুদিন অবস্থান করেন। তারপর ৫ মে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করা শুরু করেন।

সনজীদা খাতুন ছায়ানট ও জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি মোট ১৬টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ, ধ্বনি থেকে কবিতা, শ্রীখনণ্ডের পদাবলি, অতীত দিনের স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান, ধ্বনির কথা আবৃত্তির কথা, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, জননী জন্মভূমি, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনের দিনগুলি, জীবনবৃত্ত প্রভৃতি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সনজীদা খাতুন বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), দেশিকোত্তম পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। এছাড়া কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালে তাকে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি, ২০১৯ সালে ‘নজরুল মানস’ প্রবন্ধ গ্রন্থের জন্য ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল’ সাহিত্য পুরস্কার দেয়। ২০২১ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে।

বাংলাদেশে সুস্থধারার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে ক’জন ব্যক্তি অবদান রেখেছেন সন্‌জীদা খাতুন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের একজন কিংবদন্তি। প্রায় ৭২ বছর ধরে বাঙালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় চিহ্নায়নে একজন কীর্তিমান গবেষক, শিক্ষক, শিল্পী ও সংগঠক হিসেবে তিনি ছিলেন আমাদের একান্ত ভরসার স্থান। বাংলাদেশের যে কোনো গণতান্ত্রিক লড়াই, বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সন্‌জীদা খাতুন ছিলেন সামনে সারিতে। তিনি দেশের নানা সংকট ও সম্ভাবনায় তারুণ্যকে সাহস দিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন। সর্ব অর্থেই সন্‌জীদা খাতুন হয়েছেন আমাদের জীবনের এক প্রেরণার উৎস। বাতিঘর। সেই বাতিঘরকে আমরা হারালাম। কিন্তু এখন যে এমন বাতিঘরের আমাদের বড় প্রয়োজন। তাঁর অবদান আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে, মননকে করেছে আলোকিত। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও কর্মপ্রেরণা আমাদের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ ও স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখক ও প্রাবন্ধিক মোরশেদ শফিউল হাসান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ এবং ছায়ানট-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুতে গভীর শোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তিনি ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। ছাত্র হিসেবে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছি, যা কোনোদিন ভুলবার নয়। ভাবতেই পারছি না, আর কোনোদিন কোথাও তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না! যতদিন বাঁচব আমার এবং আমাদের সময়ের আরও অজস্র জনের মনে তাঁর স্মৃতি জাগরুক থাকবে। ১৯৬০ দশক থেকে এদেশের সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলনে তাঁর অবিচল সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা আজ ইতিহাসের বিষয়বস্তু, যা কোনোদিনই মুছবার নয়। আমাকে যা বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতো তা তাঁর অনমনীয় ব্যক্তিত্ব এবং স্পষ্টবাদিতা। বিদায়বেলায় তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই। আপা, যেখানেই যান, যেন খুব ভালো থাকেন।’

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং উন্নত মননের মানুষ গড়ার সংগ্রামে আজন্ম সংগ্রামী এবং বহু মানুষের স্বপ্নের সারথি সন্‌জীদা খাতুন- আপনাকে নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, বিশেষণ বা আপনার মতো মহিরুহকে নিয়ে কিছু লেখার সেই দুঃসাহস আমাদের নেই। আপনি বাংলাদেশের মনন সংস্কৃতিতে প্রগতিশীলতার চর্চায় আজন্ম যে অবদান রেখেছেন এবং ছায়ানটের ইতিহাস জন্ম-জন্মান্তর প্রবাহমান হবে শুধু এই বাংলাদেশে। পৃথিবীর পথে আপনার যাত্রা শেষ হল— অনন্তলোকে অক্ষয় তারকা হয়ে চির জাগরূক সত্তা আপনি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে  স্বমহিমায় বিরাজমান থাকবেন।

লেখক : কবি ও গবেষক

  • ছায়ানট
  • রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী
  • সন্‌জীদা খাতুন
  • মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।