
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পুনরায় ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান মাজার ও আখড়ায় আক্রমণ করা হয়েছে। এ মাসে মাজার ও মুক্তচিন্তা বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ১৪টি ঘটনা জানা গেছে। এরমধ্যে ১২টি মাজার–দরবার–খানকায় হামলার ঘটনা রয়েছে।
গত আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে বাংলাদেশি নির্যাতন-হত্যা কমলেও বেড়েছে বাংলাদেশে জোরে করে ঠেলে দেওয়ার (পুশ ইন) ঘটনা। মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশি নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিবেদনের এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
মাজারে হামলা-অগ্নিসংযোগ : গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে মাজার ও মুক্তচিন্তা বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা লংঘনের ১৪ টি ঘটনা জানা গেছে। যার মধ্যে রয়েছে- সিলেটের ৪টি মাজার, কুমিল্লাতে ৪টি মাজার, রাজবাড়ির দরবার শরীফ, রাজশাহীর খানকা শরীফ, নেত্রকোণায় পীরের আস্তানা, ময়মনসিংহে খানকা শরীফে অগ্নিকাণ্ড, ভাংচুর ও হামলা।
এছাড়াও কুষ্টিয়ায় লালন ফকিরের আখড়ায় হামলার হুমকি, ময়মনসিংহে ৪ মাস আগে বৃদ্ধ হালিম উদ্দিন ফকিরের জোড়পূর্বক চুল কাটার ঘটনা, যা এ মাসে ভাইরাল হয়। সিলেটে ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) পথযাত্রায় হামলা, কুমিল্লায় মহানবীকে কটূক্তির অভিযোগে মুসলিম যুবক এবং মাগুরায় দুর্গা প্রতিমার ডান পাশে থাকা অসুরের অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগে সনাতন ধর্মাবলম্বী যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
৫ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার দরবার শরিফে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় রাসেল মোল্লা (২৮) নামে ১ জন নিহত এবং ৫০ জনের অধিক আহত হয়েছে। গত ২৩ আগস্ট মারা যাওয়া নুরাল পাগলার লাশ মাটি থেকে কয়েক ফুট উপরে দাফন করার অভিযোগে ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয় এবং কবর থেকে ৫ সেপ্টেম্বর লাশ তুলে পোড়ানো হয়।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা : সেপ্টেম্বর মাসে ৩৬১টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা হয়েছে, যা গত মাসের তুলনায় ১২টি বেশী। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৫৩টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৩টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৩টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী। ধর্ষণের শিকার ৫৩ জনের মধ্যে ১৫ জন শিশু, ১৮ জন কিশোরী রয়েছে। অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২ জন শিশু, ৩ জন কিশোরী ও ৮ জন নারী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ২ জন শিশু ও ১ জন কিশোরী। ধর্ষণের চেষ্টা ২৮টি, যৌন হয়রানি ২৪টি, শারীরিক নির্যাতনের ৯৯টি ঘটনা হয়েছে। এসিড নিক্ষেপে আক্রান্ত হয়েছেন ১ জন পুরুষ ও ২ জন নারী।
এ মাসে ১৩ জন কিশোরী ও ২৬ জন নারীসহ মোট ৩৯ জন আত্মহত্যা করেছেন। এ মাসে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১ জন শিশু, ৩ জন কিশোরী ও ২ জন নারী অপরদিকে ২ জন শিশু, ৩ জন কিশোরী ও ৩ জন নারী নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়াও সেপ্টেম্বর মাসে ৩ জন শিশু, ৪ জন কিশোরী ও ৪ জন নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ৮৩ জন শিশু, কিশোরী ও নারী হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ৩৪ জন শিশু ও কিশোরী রয়েছেন।
বিএসএফ এবং আরাকান আর্মির তৎপড়তা : বিএসএফের পুশ ইন কার্যক্রম বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী নাগরিকদের জনজীবনে আতঙ্ক ও ভীতির সৃষ্টি করে এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করছে। যদিও বিএসএফ পুশ ইনের বিষয়টি অস্বীকার করে বলছে, বাংলাদেশি নাগরিক যারা স্বেচ্ছায় তাদের দেশে ফিরতে চাচ্ছে শুধুমাত্র তাদের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে যাদেরকে পাঠানো হচ্ছে তারা অধিকাংশ বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করে আসছিল। ভারতের একতরফা পদক্ষেপ স্বীকৃত প্রত্যাবাসন ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির লঙ্ঘন।
এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে সীমান্তে বিএসএফের ছোঁড়া গুলিতে ১ জন নিহত, ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় বিএসএফের নির্যাতনে ২ জন আহত হয়। এছাড়াও ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে এক অজ্ঞাত বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার মৃতদেহ পাওয়া যায়। এছাড়াও সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের ভারতীয় সীমান্ত থেকে ছয় বাংলাদেশি জেলেকে অপহরণ করে ভারতীয় জলদস্যুরা।
অপরদিকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের টেকনাফে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সদস্য কর্তৃক পাঁচটি ট্রলার এবং তিনটি নৌযানসহ ৫৮ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে। ফলে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকেরা উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কে জীবনযাপন করছে।
প্রতিবেদনে অন্যান্য বিষয়ে যা রয়েছে : সেপ্টেম্বর মাসে বিক্ষোভ দমনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের দুটি ঘটনায় গুলিতে ৪ জন নিহত ও অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। এছাড়া, সেপ্টেম্বর মাসে গাজীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, বাগেরহাট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন থানা হাজতে ২ বন্দির আত্মহত্যাসহ মোট ৫ জনের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে। এ মাসে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালাতে গিয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে, পুলিশী হেফাজতে নির্যাতনের একটি এবং কারা হেফাজতে আসামি মৃত্যুর ৮টি ঘটনা হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে কারা হেফাজতে মোট ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এর সংখ্যা ছিল ১০। এ মাসে ২ জন কয়েদি ও ৬ জন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রাজনৈতিক সহিংসতা আগস্ট মাসের তুলনায় কমেছে। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনায় হামলার শিকার হয়েছেন ২৯৪ জন। তাদের মধ্যে ৭ জন নিহত এবং ২৮৭ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে ১৯ জন গুলিবিদ্ধ। নিহতদের মধ্যে ৭ জন বিএনপির কর্মী সমর্থক এবং ১জনের রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট নয়। সহিংসতার ৩৮টি ঘটনার মধ্যে ৫টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ এবং সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকান্ড এবং ককটেল বিষ্ফোরণের ঘটনা হয়েছে।
সহিংসতার ৩৪ টি ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বে ১৭টি, বিএনপি-আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে ১০ টি, এনসিপি–অওয়ামী লীগ দ্বন্দ্বে ১টি, বিএনপি-এনসিপি দ্বন্দ্বে ১টি, বিএনপি-জামাত সংঘর্ষের ৫টি ঘটনা হয়েছে।
এমএসএফের প্রতিবেদন বলছে, নিবর্তনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নিলেও এ আইনের অপব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। অধিকারকর্মী ও জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় এ অধ্যাদেশকে আগের তুলনায় উন্নত বললেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কিছু বাধা রয়েই গেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী, এ মাসে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে করা ১টি মামলায় এক যুবককে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সেপ্টেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ২৯টি ঘটনায় ৬৩ জন সাংবাদিক নানাভাবে হামলা, আইনি হয়রানি, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে এমএসএফ জানায়, আগস্ট মাসে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ছিল ৮টি। এ মাসে ইতোমধ্যে তা বেড়ে দ্বিগুনে দাঁড়িয়েছে। ১৬টি ঘটনায় সারাদেশের পঞ্চগড়, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, মুন্সিগঞ্জ, জামালপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নেত্রকোণা, কুষ্টিয়া, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, জয়পুরহাট, গাইবান্ধাসহ ১৬টি জেলায় ২৯টি প্রতিমা ভাংচুর, ৬টি প্রতিমাতে আগুন, ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ১ জন গ্রেপ্তার, ২টি মন্দিরে চুরি ও ২টি জমি দখল সংক্রান্ত ঘটনা হয়েছে। অন্যদিকে, সেপ্টেম্বর মাসে জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ৩টি ঘটনা হয়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সেপ্টেম্বর ২০২৫ মাসে একই ধারাবাহিকতায় অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা রয়েছে। এ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১ জন শিশু, ২ জন কিশোর, ১৩ জন নারী ও ৩৬ জন পুরুষ, মোট ৫২টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে।
গণমাধ্যমসূত্রে পাওয়া এমএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে অন্তত ৪৩টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ২৪ জন নিহত ও ৩২ জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। গণপিটুনির শিকার ২০ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে।
অপরদিকে এ মাসে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে জোরপূর্বক চুল কেটে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা মর্যাদাহানিকর, অমানবিক, বে-আইনি ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।