সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। এই আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের মোট ২০৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের ১১৭ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ছাত্রদলের ৩৪, যুবদলের ৩৫, স্বেচ্ছাসেবক দলের ৯, শ্রমিক দলের ১৪, কৃষক দলের ৪, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ৬, দক্ষিণ বিএনপির ১২, মৎস্যজীবী দলের ২ এবং জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসের এক নেতাকর্মীর মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী চিকিৎসাধীন থাকায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৮৭ জন নেতাকর্মীও নিহত হয়েছেন। জামায়াতের সূত্রে জানা যায়, শিবিরের অন্তত ৫৩ জন নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। প্রথম দিন ১৬ জুলাই শিবিরের দুই নেতা নিহত হন। ১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার পর ৪ ও ৫ আগস্ট জামায়াত-শিবিরের ৬০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। যদিও দলটি এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।

বিএনপি এবং এর অঙ্গসংগঠনের নিহত নেতাকর্মীদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে ৪ ও ৫ আগস্ট। যদিও দলটি নির্ভুল সংখ্যা জানাতে পারেনি। গণঅধিকার পরিষদের ৯ নেতাকর্মীও এই আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন।

সমকালের হিসাব অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৬২৩ জন নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা অন্তত ৬৫০ জন। সরকারি হাসপাতালগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ৪০৮ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছিলেন, নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়াতে পারে।

এই আন্দোলনের সূচনা হয় ১ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছে, তবে গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে যে প্রথম দিকে এই দুটি দলের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না।

১৪ জুলাই শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের সন্তান’ বলে অভিহিত করেন। এর ফলে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটে। ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। সেদিন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম নিহত হন এবং ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী সবুজ আলীসহ ছয়জন নিহত হন।

১৮ থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে পুলিশের, র‌্যাবের এবং আনসারের নির্বিচার গুলিতে ২১২ জন নিহত হন এবং প্রায় ৬ হাজার মানুষ আহত হন, যাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হিসাব অনুযায়ী, এই সময়ে ২৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত অনেকে পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

নিহতদের মধ্যে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, জাসাস, জামায়াতে ইসলামী, শিবির ও অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা রয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর অবস্থায় আছেন, কেউ অন্ধ হয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন হাত-পা।

বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল ছাত্ররা। এতে স্বৈরাচারের দমনপীড়নে সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছিল। দেশ রক্ষার এই আন্দোলনে বিএনপির তরুণ ও যুবকরা দেশপ্রেমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বহু নেতাকর্মী নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়েছেন।’

জামায়াতের নেতাদের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হলে ৩১ জুলাই সারাদেশকে ৯ ভাগে ভাগ করে পরিকল্পিত আন্দোলন শুরু হয়। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, তখন পিছু হটার কোনো সুযোগ ছিল না। তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় খাবার, জনবল, যানবাহন ও চিকিৎসার সাহায্য প্রদান করেছেন।

বিএনপি জেলা, মহানগর ও উপজেলায় হতাহতের তালিকা চেয়েছে। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, সারাদেশে ৩৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন এবং দেড় হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। অনেকেই এখনও মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন।

নিহত নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন:

  • ছাত্রদল: মেহেদী হাসান রাব্বি, মানিক মিয়া শারিক, মোহাম্মদ ওয়াসিম আকরাম, আরিফুর রহমান রাসেল, সাকিবুল হাসান মাহি, তানভীর রাইহান আলিফ, ইউসুফ আলী, ফরিদ শেখ, সাগর আহমেদ, রিপন চন্দ্র শীল, ইসমাইল হোসেন রাব্বি, শাওন, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, মোহাম্মদ সুমন, সামিম হাওলাদার, মনির হোসেন, ইরফান ভূঁইয়া, ইমতিয়াজ আহমেদ, মাহবুব প্রমুখ।
  • যুবদল: হাফিজুর রহমান, মোসলেহউদ্দিন, ওবায়দুল, সজীব, মহিনউদ্দিন, শাহনেওয়াজ, নবীন তালুকদার, ওয়াসিম শেখ, সাঈদ খান, নাদিম, শামীম হাওলাদার, মহিউদ্দিন বয়াতি, ওমর ফারুক, শিহাবউদ্দিন, মোসলেমউদ্দিন, আরিফ, রিয়াজ, মোসলেমউদ্দিন মিলন, মেরাজুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসাইন, ইমন হাজী, মুহাম্মদ পারভেজ, সাজন, মোহাম্মদ মাসুম, নুর আলম, আজিজুল হক।
  • স্বেচ্ছাসেবক দল: শাহরিয়ার হোসেন আবির, যুবায়ের হোসেন, মোহাম্মদ সাগর, মনির হোসেন, মিরাজ, আল আমিন, আল মামুন, শাহান পারভেজ, রুবেল আহমেদ।
  • শ্রমিক দল: মো. জাহাঙ্গীর, জালাল উদ্দিন, মনির হোসেন, আক্তার হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন, মোহাম্মদ আসিফ, মোহাম্মদ সোহাগ, মোহাম্মদ রাজন, মোহাম্মদ রাকিব, জাহাঙ্গীর আলম, হৃদয় হাওলাদার, শামছু মোল্লা, মোস্তাক মিয়া।
  • কৃষক দল: মোহাম্মদ শরীফ, মোহাম্মদ সুমন, জাহিদুর ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম সাগর।
  • মৎস্যজীবী দল: মো. হৃদয়, রুবেল মিয়া।
  • জাসাস: জসিমউদ্দিন।
  • জামায়াত ও শিবির: শাকিল পারভেজ, আবদুল্লাহ আল তাহির, মুহাম্মদ রায়হান, মাহফুজ হোসেন, একরাম হোসেন কাউসার, মুহাম্মদ এলেম, মুহাম্মদ নাসির ইসলাম, মুহাম্মদ আদিল, সাইয়্যেদ মুনতাসির রহমান, মুহাম্মদ ইরফান ভূঁইয়া, নাহিদ হাসান, কাউছার হোসেন বিজয়, সাদ আল আফনান, ওসমান পাটওয়ারী, জাহিদ হাসান, মিকদাদ হোসেন খান আকিব, ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, মুহাম্মদ মারুফ হোসাইন, রিফাত হোসাইন, সামিউ আমান, মুনতাসির রহমান আলিফ, মাহবুব হাসান মাছুম, মোতাকিম বিল্লাহ, আব্দুল্লাহ কবির, কবির হোসেন, মোহাম্মদ তাহমিদ।