বাংলাদেশের ইসলামি ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত গত ৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ওলামা মাশায়েখ বাংলাদেশ’ এর উদ্যোগে ইসলামি মহাসম্মেলন। সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-মাশায়েখ, তাবলিগ জামাত ও কওমি মাদরাসার প্রতিনিধিরা। এতে তারা তাদের ৯ দফা দাবি তুলে ধরেন, যার মধ্যে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের অমুসলিম ঘোষণার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

এই সম্মেলনে বলা হয়েছে যে, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র রোধ করতে হবে এবং ইসলামিক মূল্যবোধকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। ৯ দফা দাবি বেশ স্পষ্ট এবং গভীর গুরুত্বের দাবি করছে, যার মধ্যে কওমি মাদরাসা, তাবলিগ জামাত, এবং দ্বীন রক্ষা করার জন্য কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছে।

ওলামা-মাশায়েখদের ৯ দফা

৯ দফা দাবি

১. কওমি মাদরাসার স্বাধীনতা রক্ষা:
কওমি মাদরাসাগুলোর উপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে, ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারী মহল থেকে মাদরাসাগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

  1. ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা:
    সাধারণ শিক্ষা সিলেবাসের সকল স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  2. মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার:
    বিগত সরকার আমলে মজলুম আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতার বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
  3. শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচার:
    ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে নবীপ্রেমিক নিরীহ মুসল্লিদের ওপর বর্বরোচিত হামলার দোষীদের শাস্তির আওতায় এনে দ্রুত বিচার কার্যকর করতে হবে।
  4. টঙ্গী ময়দানে হামলার বিচার:
    ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর টঙ্গী ময়দানে সাদপন্থীদের হামলার ঘটনায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
  5. মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ:
    মাওলানা সাদ কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা, নবী-রাসুল ও সাহাবাদের সমালোচনা, এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদাবিরোধী বক্তব্য দেয়ায়, তাকে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না।
  6. বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে আয়োজন:
    বিশ্ব ইজতেমা এক পর্বে আয়োজন করা কঠিন হওয়ায়, আগামী ইজতেমা দুই পর্বে আয়োজিত হবে: প্রথম পর্ব ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব ৭-৯ ফেব্রুয়ারি।
  7. কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গী ইজতেমায় সাদপন্থীদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ:
    কাকরাইল মসজিদ এবং টঙ্গী ময়দানে চলমান সব কার্যক্রম উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে, সাদপন্থীদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না।
  8. কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা:
    কাদিয়ানীদের অবিলম্বে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং তাদের ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।

৯ দফা দাবি: কওমী মাদরাসা রক্ষা ও ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা

সম্মেলনে সবার আগে যে দাবি তোলা হয়েছে, তা হলো কওমী মাদরাসাগুলোর উপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। কওমী মাদরাসাগুলি দীর্ঘদিন ধরে দারুল উলুম দেওবন্দের অনুকরণে দ্বীনি শিক্ষা প্রদান করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে সরকার এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের হস্তক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। তাই এই সম্মেলন থেকে কওমী মাদরাসাগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।

এছাড়া সাধারণ শিক্ষা সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবিও উঠেছে। এতে করে সব স্তরের শিক্ষার্থীরা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা পেতে সক্ষম হবে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে।

তাছাড়া, ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে নিরীহ মুসলমানদের উপর যে বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়েছিল, তার বিচার দাবিও উত্থাপন করা হয়েছে। তারা দাবি করেছেন, যারা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিলেন, তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে। একই সঙ্গে ২০১৮ সালে টঙ্গী ময়দানে মাওলানা সাদপন্থীদের হামলারও নিন্দা জানানো হয় এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তোলা হয়।

মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে না দেয়ার দাবি

এছাড়া, সম্মেলনে মাওলানা সাদ কন্ধলভী সম্পর্কে তীব্র অভিযোগও উত্থাপন করা হয়। মাওলানা সাদ তার বক্তব্যে কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা এবং সাহাবায়ে কেরামদের সমালোচনা করে ইসলামি আকীদার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়। ইসলামি মহাসম্মেলনে উপস্থিত আলেমরা বলছেন, মাওলানা সাদ তাঁর নিজস্ব মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে তাবলিগ জামাতের আদর্শের বিরোধিতা করেছেন, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সঙ্গে মেলে না। তাই, মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত

সম্মেলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ছিল বিশ্ব ইজতেমার আয়োজনে পরিবর্তন আনা। উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে শুরারি নেজামে পরিচালিত ইজতেমা দুটি পর্বে আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্ব হবে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি, এবং দ্বিতীয় পর্ব ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে।

এছাড়া, কাকরাইল মসজিদ এবং টঙ্গী ময়দানের বিশ্ব ইজতেমার যাবতীয় কার্যক্রমও উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। এখানে সাদপন্থীদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না, এমনও ঘোষণা দেয়া হয়।

কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা

সম্মেলনের সবচেয়ে বিতর্কিত দাবি ছিল কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অবিলম্বে অমুসলিম ঘোষণা করার এবং তাদের ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আহ্বান। কাদিয়ানী সম্প্রদায় ইসলামের মৌলিক তত্ত্ব এবং মুসলিমদের বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে অভিযোগ করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

সম্মেলনে বিশাল জমায়েত

এবারের সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা উপস্থিত হয়েছিলেন, এবং তারা একযোগভাবে নিজেদের দাবির পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করেন। সম্মেলনটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সীমানা ছাড়িয়ে রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মৎস ভবন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, শাহবাগ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। পুরো শহরে এক ধর্মীয় আবহ বিরাজ করছিল।

সম্মেলন শেষে ওলামা-মাশায়েখরা তাদের ৯ দফা দাবির সমর্থনে সরকারের প্রতি কড়া অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানান এবং ইসলাম ও মুসলমানদের নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলেন।