বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো তরুণ ছাত্রদের হাত ধরে। ১৯৯০ সালে ছাত্ররা স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘ বিরতির পর, ২০২৪ সালে আবারও ছাত্রদের আন্দোলন বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিল। এবার স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন শেষ হলো।
শেখ হাসিনার শেষ দিনগুলো
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। তবে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সমাধান করতে তিনি ব্যর্থ হন। প্রতিনিয়ত বিতর্কিত বক্তব্য এবং ভুল সিদ্ধান্তের ফলে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। আন্দোলনের চাপে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। ৫ আগষ্ট সোমবার দুপুরে সামরিক হেলিকপ্টারে গণভবন ত্যাগ করে তিনি নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তার ছোটবোন শেখ রেহানা এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর, ক্ষিপ্ত জনতা গণভবনে ঢুকে পড়ে।
কোটা আন্দোলন
২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন শুরু হয় পাঁচ দফা দাবি নিয়ে। পরে, ৯ দফা দাবি এবং সবশেষে এক দফা দাবি দিয়ে আন্দোলনকারীরা সরকারের পতন ঘটান। ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। এরপর শাহবাগে সমাবেশের ওপর সরকারি বাহিনী কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিপেটা করে।
কোটা সংস্কারের সিদ্ধান্ত: ১১ এপ্রিল ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। এটি একটি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ছিল বলে পরে তিনি স্বীকার করেছেন। ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা হাইকোর্টে একটি রিট করেন।
হাইকোর্টের রায়: ৬ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে হাইকোর্ট কোটা পরিবর্তনের নির্বাহী পরিপত্র বাতিল করে। এর বিরুদ্ধে সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। ২৩ জুলাই ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের বিতর্কিত রায় বাতিল করে এবং সরকারি চাকরিতে ৭ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রাখার নির্দেশ দেয়।
১৪ জুলাই
রবিবার (১৪ জুলাই) বিকেলে চীন সফর নিয়ে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেনঃ
১৪ জুলাই, ২০২৪ শেখ হাসিনা বলেন, কোটা বিষয়ে তার কিছু করার নেই এবং আদালতের রায় মেনে নিতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে? তা তো আমরা দিতে পারি না।
এই মন্তব্যের পর ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ, বিভিন্ন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়, এর কারন তার এই কথা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ছাত্রলীগের হামলা: ১৬ জুলাই ছাত্রলীগের হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: আন্দোলনের সহিংসতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তথ্য অনুসন্ধান দল পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করে।
৫ জুন – ১৬ জুলাই আন্দোলনের মূল ঘটনা:
- ৫ জুন: হাইকোর্ট কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে।
- ৯ জুন: কোটা বাতিলের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামে।
- ১ জুলাই: কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়।
- ৭ জুলাই: ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি শুরু হয়।
- ১৪ জুলাই: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্যের পর বিক্ষোভ তীব্র হয়।
- ১৫ জুলাই: ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষার্থীরা আহত হন।
- ১৬ জুলাই: সারা দেশে সহিংসতার ঘটনায় ৬ জন নিহত হয়।
আন্দোলনের ধরণ পরিবর্তন: অন্যদিকে, আন্দোলনকারীরা মিছিল ও প্রস্তাবনা দিয়ে সরকারের কাছে দাবি জানান। ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন, যা প্রত্যাখ্যাত হয়।
কারফিউ ও সহিংসতা: ২২ জুলাই থেকে কারফিউ শুরু হয় এবং সহিংসতা বাড়তে থাকে। ২৪ জুলাই অফিস খুলে দেওয়া হয়, কিন্তু সংঘাত অব্যাহত থাকে।
২২ জুলাই, সোমবার:
- তীব্র আন্দোলন: কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা সরকারের কাছে তাদের চার দফা দাবির বাস্তবায়ন দেখার জন্য ৪৮ ঘণ্টার শাটডাউন স্থগিতের ঘোষণা দেন।
- সাধারণ ছুটি বাড়ানো: সাধারণ ছুটির মেয়াদ মঙ্গলবার পর্যন্ত বাড়ানো হয় এবং কারফিউও বাড়ানো হয়।
- নিহতের সংখ্যা: সহিংসতায় ১৩১ জন নিহত হওয়ার খবর আসে এবং পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।
- ইন্টারনেট: ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা সীমিতভাবে পুনরায় চালু হয়।
২৩ জুলাই, মঙ্গলবার:
- ইন্টারনেট পরিষেবা: ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা আবারও চালু হয়।
২৪ জুলাই, বুধবার:
- অফিস কার্যক্রম: নির্বাহী আদেশে তিনদিনের সাধারণ ছুটির পর অফিস খোলে। কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানো হয়, বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অফিস কার্যক্রম চলে।
২৬ জুলাই, শুক্রবার:
- প্রধানমন্ত্রীর সফর: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে ধ্বংসযজ্ঞ পরিদর্শন করেন।
- বক্তব্য বিতর্ক: শেখ হাসিনা দাবি করেন, তার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে এবং তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেননি।
২৭ জুলাই, শনিবার:
- বিএনপি-জামায়াত অভিযোগ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করেন এবং পঙ্গু হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান।
২৮ জুলাই, রবিবার:
- নিহতদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের সাথে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন এবং আহতদের দেখতে রাজারবাগের পুলিশ হাসপাতালে যান।
- মৃত্যুর সংখ্যা: সহিংসতায় ১৪৭ জন নিহত হওয়ার তথ্য আসে।
২৯ জুলাই, সোমবার:
- জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ: ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়।
- সংঘর্ষের ঘটনা: কোটা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে দেশে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়।
৩০ জুলাই, মঙ্গলবার:
- শোক পালনের আহ্বান: কোটা আন্দোলনের নিহতদের স্মরণে শোক পালনের আহ্বান জানানো হয়। আন্দোলনকারীরা ফেসবুক প্রোফাইল লাল করে এবং চোখে কালো কাপড় বেঁধে ছবি পোস্ট করার আহ্বান জানান।
৩১ জুলাই, বুধবার:
- মার্চ ফর জাস্টিস: আন্দোলনের বিচার দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হয়, যার ফলে দেশে বিভিন্ন স্থানে সংঘাত ঘটে।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুষ্ঠু তদন্তে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা চান এবং জাতিসংঘও তথ্য অনুসন্ধান দল পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করে।
১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার:
- ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য জামায়াত-শিবির ও এর অঙ্গ সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়।
২ আগস্ট, শুক্রবার:
- হামলা ও সংঘর্ষ: গণমিছিলে হামলা ও সংঘর্ষে ২ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
৩ আগস্ট, শনিবার:
- আলোচনার প্রস্তাব: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের আলোচনার প্রস্তাব দেন, কিন্তু আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।
- সরকার পতনের দাবি: কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সরকারের পতন দাবি করে বিশাল জমায়েত হয়।
৪ আগস্ট, রবিবার:
- অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়, যা দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘাতে পরিণত হয় এবং অনেক শিক্ষার্থীসহ, নিরিহ মানুষ নিহত হয়।
৫ আগস্ট ২০২৪, সোমবার:
৫ আগস্ট, ২০২৪-এ বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সফলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন:
- পুলিশের অভিযান: আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলতে থাকে এবং বিভিন্ন শহরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। পুলিশ বিশেষ করে আন্দোলনকারীদের পরিচয় যাচাই এবং তাদের আন্দোলনের জায়গাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে।
- সরকারের পদক্ষেপ: সরকার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, এবং বিভিন্ন কর্মসূচি ও মিছিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
- আন্দোলনকারীদের সমাবেশ: আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন শহরে ছোট ছোট সমাবেশ এবং বিক্ষোভ করে তাদের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে। এসব সমাবেশে পুলিশের সাথে সহিংসতা আরো বাড়তে থাকে।
- আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সরকারের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়।
৫ আগষ্ট সোমবার ছাত্র দের উপর হত্যা আরো বেড়ে জাই, কিন্তু ছাত্রসহ, দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এর আন্দোলন এতটাই তীব্র ছিল, পরবর্তীতে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এবং তিনি সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে, দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
সেনাপ্রধানের বক্তব্য
সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ জামান নিশ্চিত করেছেন যে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং শিগগিরই একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। তিনি দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠন
বিরোধী পক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সরকার একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে এগিয়ে যায়। ছাত্র আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি নিয়ে বৈঠকে বসে এবং সরকারকে বিভিন্ন দাবি পূরণের আল্টিমেটাম দেয়।
শেষমেশ, আন্দোলনের ফলস্বরূপ
২০২৪ সালের কয়েক মাস আন্দোলন শেষে শেখ হাসিনার পতন ঘটে এবং নতুন সরকার গঠনের পথে অগ্রসর হয় বাংলাদেশ। আন্দোলনের পর, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উত্থান-পতনের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়, যা বাংলাদেশ ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে।