পৃথিবীতে সন্তানদের জন্য পিতামাতার স্নেহ, মমতা, এবং ভালোবাসা অপরিসীম। পিতামাতার অভাব পূরণ করা সম্ভব নয় এবং তাদের মর্যাদা সর্বাধিক। তাই তাদের জন্য প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করা সন্তানের মৌলিক কর্তব্য। ইসলাম ধর্মে পিতামাতার প্রতি সম্মান এবং তাদের জন্য দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মৃত্যু আল্লাহর বিধান হিসেবে সকল জীবিত মানুষকে একদিন স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। মৃত্যুর পর সকল মানুষের কবরস্থানে যাওয়া এক ধরনের দায়িত্ব এবং কর্তব্য, বিশেষ করে মৃত আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। ইসলামে কবর জিয়ারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মাধ্যমে আমরা পরকালের স্মরণ রেখে চলতে পারি।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা: আনকাবুত, আয়াত: ৫৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কবর জিয়ারতের মাধ্যমে দুনিয়াবিমুখতা আসে এবং আখিরাতের কথা স্মরণ হয়। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৫৭১)
কবর জিয়ারতের দোয়া
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার কবরবাসীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই দোয়া পাঠ করেছেন:
- “اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ القُبُورِ، يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ، أَنْتُمْ سَلَفُنَا، وَنَحْنُ بِالأَثَرِ”
উচ্চারণ: আসসালাামু ‘আলাইকুম ইয়া আহলাল ক্বুবূরি ইয়াগফিরুল্লাাহু লানাা ওয়ালাকুম, আনতুম সালাফুনাা ওয়া নাহনু বিল আসার
অর্থ: হে কবরবাসী! আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ তাআলা আমাদের, আপনাদের ক্ষমা করে দিন। আপনারা আমাদের পূর্বে গমনকারী। আমরাও আপনাদের পিছনে পিছনে আসছি।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি কবর জিয়ারতে গিয়ে বলেন:
- “السَّلامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤمِنينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاحِقُونَ”
উচ্চারণ: আসসালামু আলাইকুম দারা ক্বাওমিন মুমিনিন ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লা-হিকুন
অর্থ: মুমিন এ ঘরবাসীদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইনশাআল্লাহ আমরা আপনাদের সঙ্গে মিলিত হবো।
কবর জিয়ারতের নিয়মাবলী
কবরস্থানে গিয়ে প্রথমে জিয়ারতের দোয়া পড়তে হবে। পরে কবরবাসীর জন্য ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে দরুদ শরিফ, সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সুরা ইখলাস ইত্যাদি পড়তে হবে। মৃতের মাগফিরাতের জন্য বিশেষ দোয়া করতে হবে।
- দোয়া ও ইবাদত: কবরস্থানে গিয়ে প্রথমে সালামসহ দোয়া পাঠ করতে হবে। এরপর দরুদ শরিফ, সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস, আয়াতুল কুরসি ও অন্যান্য সুরা পাঠ করে মৃত ব্যক্তির জন্য সওয়াব পাঠাতে হবে।
- দোয়া করার পদ্ধতি: কবর সামনে রেখে দুই হাত তুলে দোয়া করা উচিত নয়। কবরকে পেছনে রেখে কিংবা কবরের দিকে পিঠ দিয়ে কিবলামুখী হয়ে দোয়া করা উচিত। এছাড়া, হাতে হাত না তুলে মনে মনে দোয়া করেও জিয়ারত করা যেতে পারে।
- কবর জিয়ারতের সময়: কবর জিয়ারতের জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। যেকোনো দিন, যেকোনো সময় কবর জিয়ারত করা যায়। তবে জুমার দিন কবর জিয়ারত করলে ক্ষমা লাভের সম্ভাবনা থাকে।
কবর জিয়ারতের পদ্ধতি
কবর জিয়ারতের নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি হাদিসে উল্লেখ নেই। তবে, কবরস্থানে গিয়ে প্রথমে সালাম দিয়ে দোয়া করতে হয়।
পদ্ধতি:
- কবরস্থানে গিয়ে পবিত্র অবস্থায় প্রথমে সালাম দিন।
- এরপর দরুদ শরিফ, সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সূরা ইখলাস এবং অন্যান্য সহজ সূরা পাঠ করুন।
- মৃতের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করুন।
ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতে, সুরা মুলক তিলাওয়াত করা কবরবাসীর জন্য উপকারি। এটি কবরের আজাব থেকে মুক্তি দেয়। (জামে তিরমিজি, হাদিস: ২৮৯০)
কবর জিয়ারতের বিশেষ পরামর্শ
কবর জিয়ারত করার সময় কিছু বিশেষ দোয়া পাঠ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে:
১. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী: রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার কবরবাসীদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই দোয়া পাঠ করেছেন:
- দোয়া: ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর, ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম, আনতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিল আসার।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১০৫৩)
২. আবু হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী: একবার রাসুল (সা.) একটি কবর জিয়ারতে গিয়ে বলেন:
- দোয়া: ‘আসসালামু আলাইকুম দারা ক্বাওমিম মুমিনিন ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লাহিকুন।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৪৯)
কবর জিয়ারতের উপকারিতা
কবর জিয়ারতের মাধ্যমে অনেক উপকারিতা পাওয়া যায়:
- সওয়াব লাভ: কবর জিয়ারতকারী সওয়াব লাভ করে।
- আত্মীয়তার সুসম্পর্ক বজায় থাকে।
- পরকালের প্রস্তুতির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি প্রতি জুমায় তার মা-বাবা বা তাদের একজনের কবর জিয়ারত করবে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং তাকে মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারকারী হিসেবে গণ্য করা হবে। (আল মুজামুল আউসাত: ৬১১৪)
কবর জিয়ারতের সময় কি করতে হবে এবং কি করা উচিত নয়
- কবর জিয়ারতের সময়: হাত তুলে দোয়া করা মন্দ নয়, তবে এটি জরুরি নয়। কবরের দিকে পিঠ দিয়ে কিবলামুখী হয়ে দোয়া করতে হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৭৪)
- যা করা উচিত নয়: কবরের পাশে কান্না করা, হা-হুতাশ করা এবং কবরের মাটি ছুঁয়ে সালাম করা ইসলামিক শিরক হিসেবে বিবেচিত হয়।
হাদিস: রাসুল (সা.) কবরস্থানে গিয়ে কিবলামুখী হয়ে তিনবার হাত উঠিয়ে দোয়া করেছিলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৭৪)
কবর জিয়ারতে যা করা উচিত নয়
রাসুলুল্লাহ (সা.) কবরস্থানে কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন:
- কবরের ওপরে বসা: কবরের ওপর বসা নিষেধ। এটি সমপরিমাণ আগুনের ওপর বসার চেয়ে খারাপ, যা কাপড় পোড়ানোর মতো জ্বালিয়ে দেয়।
- নামাজ পড়া: কবরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়া নিষেধ।
- পশু জবাই: কবরস্থানে পশু জবাই করা যাবে না।
- কবরকে উৎসবের জায়গা বানানো: কবরকে উৎসবের জায়গা বানানো উচিত নয়, এবং কবরের কাছে ঘর বানানো উচিত নয়।
কবর জিয়ারতের ফজিলত
কবর জিয়ারত করার মাধ্যমে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয় এবং আখিরাতের কথা মনে পড়ে। এটি মানুষকে গুনাহ থেকে তওবা করতে উৎসাহিত করে এবং সৎ আমলের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে। কবর জিয়ারত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত যা মানুষকে আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
নিষিদ্ধ কার্যাবলী ও কবরস্থানের সঠিক ব্যবহার
কবরস্থানে মসজিদের মতো ব্যবহার না করে এবং কবরের ওপর বসা, কবরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়া, পশু জবাই করার মতো কার্যাবলী পরিহার করতে হবে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞাগুলি ইসলামের পরিস্কার নির্দেশনা।
ইসলামে পিতামাতার মর্যাদা
ইসলাম পিতামাতাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পিতামাতার প্রতি উত্তম আচরণ এবং দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা আমাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতামাতার সঙ্গে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ’বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বল।” (সুরা বনি ইসরাইল: ২৩)
কোরআনে পিতামাতার জন্য দোয়া
মহান আল্লাহ কোরআনে পিতামাতার জন্য সন্তানের দোয়া করতে বলেছেন:
- “رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا” (সুরা বনি ইসরাইল: ২৪)
উচ্চারণ: রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা
অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করুন, যেমনিভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। - “رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ” (সুরা ইবরাহিম: ৪১)
উচ্চারণ: রাব্বানাগ ফিরলি ওয়ালি ওয়ালিদাইয়া, ওয়ালিল মুমিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব
অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সব মুমিনকে ক্ষমা করুন, যেদিন হিসাব কায়েম হবে।