মানুষের মৌলিক স্বভাব হচ্ছে সুন্দর, আনন্দদায়ক এবং কল্যাণকর জিনিসে আনন্দ পাওয়া এবং অসুন্দর, দুঃখজনক বা অকল্যাণকর অবস্থায় ব্যথিত হওয়া। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেই আমরা দেখতে পাই, যখন মানুষেরা অন্যায়, অসত্য ও জুলুমের চাপে নিপীড়িত হয়েছিল, তখন তারা মুক্তি ও সান্ত্বনার জন্য মুক্তিদাতা ও ত্রাণকর্তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। এই মুক্তিদাতা এমন একজন ব্যক্তি যিনি সকল দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটাতে পারে এবং সকল অশুভ শক্তিকে নির্মূল করতে সক্ষম।

একবার যখন মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছে, তখন তারা আনন্দানুষ্ঠান করেছে, যা কুরআনের ভাষায় ঈদ (عيد) বলা হয়। ঈদ হল একটি বিশেষ দিন যা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা ব্যক্তির স্মরণে উদযাপিত হয়। কিছু ভাষাবিদ মনে করেন, ঈদ শব্দটি বার্ষিক আনন্দ ও নব আনন্দের মাধ্যমে ফিরে আসার কারণে এমন নামকরণ করা হয়েছে। (আল-মুন্জিদ, পৃ. ৫৩৯)

অন্যদিকে, ‘মিলাদ’ (ميلاد) শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্ম সময়। এটি কারো জন্মের সময় বা তার জীবন সম্পর্কে আলোচনা করার সময় বোঝায়। যদিও মিলাদ একটি আরবি শব্দ, আমাদের দেশে এটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসিতে মিলাদ মানে হচ্ছে জন্ম সময়। (ফারহাঙ্গে জবানে ফারসি, পৃ. ১০৬৭)

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মুসলিম বিশ্বে প্রতি বছর রবিউল আওয়াল মাসে উদযাপিত হয়। এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন একটি প্রথা যা আল্লাহর নির্দেশনার অংশ এবং কুরআনের একটি আদর্শ বিষয়।

কুরআনে আল্লাহ বলেন: “বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত দ্বারা। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক।” (সূরা ইউনুছ: ৫৮)। এখানে আল্লাহর অনুগ্রহ বলতে ইসলামের ও কুরআনের মর্যাদা বোঝানো হয়েছে এবং রহমত বলতে রাসূল (সা.)-কে বোঝানো হয়েছে। (সূরা আম্বিয়া: ১০৭)।

ইমাম বুখারী (রহ.) একবার একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যেখানে আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার বংশের কেউ স্বপ্নে তাকে খুব খারাপ অবস্থায় দেখে। আবু লাহাব জানান যে, তার মৃত্যুর পর কোনো শান্তি নেই, তবে প্রতি সোমবার তার আযাব লাঘব হয় কারণ তিনি রাসূল (সা.)-এর জন্মদিনে দাসী সুয়াইবাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এর আনন্দের ফল কত বড় হতে পারে।

ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব বোঝার জন্য আমাদের অতীতের ইতিহাসকে দেখতে হবে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আওয়াল, যখন রাসূল (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই সময়টি পৃথিবীর জন্য একটি বিশেষ মুহূর্ত ছিল। এটা ছিল এক নতুন যুগের সূচনা, যেখানে আদর্শ ও নৈতিকতার নতুন আলো দেখা দেয়। তাঁর জন্মের ফলে পৃথিবী নতুনভাবে আলোকিত হয় এবং মানবতার জন্য এক মহান পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন।

you can also read:

রাসূল (সা.)-এর জীবন ও তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করা আমাদের জন্য একটি মহান উদ্দেশ্য। ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককে রাসূল (সা.)-এর আদর্শ অনুসারে সাজানোর একটি সুযোগ। প্রতিটি মুসলিমের উচিত ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের মাধ্যমে নিজের জীবনকে পুনর্মূল্যায়ন করা এবং রাসূল (সা.)-এর আদর্শে নিজেদের জীবন গড়ার প্রতিজ্ঞা করা।

যদি আমরা সত্যিকারভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করতে চাই, তবে আমাদের জীবনে সুন্নাহর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে এবং সমাজে সঠিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেসব দেশে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন শুধুমাত্র ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং আল্লাহর আইন ও রাসূল (সা.)-এর আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সেখানে এই উৎসবের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হয় না।