বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। বিদ্যুৎ সংকটের মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এটি একটি বহুমুখী সমস্যা, যার মধ্যে ডলার সংকট, অপরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, এবং আমদানি নির্ভরতা অন্তর্ভুক্ত।
ঘন ঘন লোডশেডিং এর প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হলো
১. ডলার সংকট
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের প্রধান কারণ হলো ডলার সংকট। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি যেমন গ্যাস, তেল, এবং কয়লা অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। ডলার সংকটের কারণে এই জ্বালানি আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে, যা সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদনকে প্রভাবিত করছে।
একইসাথে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাঝে বকেয়া বিলের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, গ্যাস ও তেলের আমদানির জন্য অতিরিক্ত ডলার ব্যয়ের ফলে সরকারকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দে সমস্যা হচ্ছে।
২. অপরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ
প্রথমত, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে গত পনেরো বছরে একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত পরিকল্পনা না থাকার কারণে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বর্তমানে কার্যকরী অবস্থায় নেই। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ক্ষমতা অপ্রতুল, ফলে লোডশেডিংয়ের সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকালে জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
৩. আমদানি নির্ভরতা
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, জ্বালানি আমদানির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার কারণে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা প্রায় বারো হাজার মেগাওয়াট, তবে বর্তমানে উৎপাদন মাত্র পাঁচ হাজার মেগাওয়াটে সীমাবদ্ধ।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হলেও সামিটের এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ কমেছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং লোডশেডিংয়ের পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।
সমাধান ও পদক্ষেপ
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন যে সাময়িক সংকট সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ডলার পেমেন্ট করা হচ্ছে এবং নতুন গ্যাসের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের যান্ত্রিক ত্রুটি দ্রুত ঠিক করার চেষ্টা চলছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য জরুরি ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। এ ছাড়া, গ্যাস রেশনিং করে তেল চালিত কেন্দ্রগুলোর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট একটি জটিল সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট। ডলার সংকট, অপরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, এবং আমদানি নির্ভরতা এই সংকটের মূল কারণ। এ সমস্যার সমাধানে সরকারকে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবেই দেশের বিদ্যুৎ সঙ্কটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে এবং জনগণের জীবনে স্বস্তি ফিরবে।