সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে (১৯৭৩) কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ পরিবর্তনগুলো মূলত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার বিচারকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে করা হচ্ছে। এই আইনের আওতায় নতুন ধারা ও উপধারা যুক্ত করা হচ্ছে, যা আইনটিকে আরো আধুনিক ও কার্যকর করবে।
আইনটিতে কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে?
আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আটটি পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- নতুন ধারা যুক্তকরণ: আইনে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে তিনটি নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে নতুন কিছু অপরাধ যেমন গুম, যৌন নির্যাতন এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।
- রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ: অপরাধ সংঘটনের জন্য অভিযুক্ত রাজনৈতিক দলকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এই বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে, কেউ কেউ মনে করেন দলকে নিষিদ্ধ না করে বরং নিবন্ধন বাতিল করা উচিত।
- বিচারের স্বচ্ছতা: বিচার কার্যক্রম ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে সম্প্রচার করার সুযোগ রাখা হয়েছে, যা বিচারকে আরো স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করবে।
- ডিজিটাল সাক্ষ্য: ডিজিটাল প্রমাণ এবং সাক্ষ্যগ্রহণের প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যা আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে।
- বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ: অভিযুক্তরা চাইলে তাদের পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন, যা আন্তর্জাতিক মানের বিচার নিশ্চিত করবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন: নতুন ধারা ও উপধারা
বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর জন্য নতুন কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাবনায় তিনটি নতুন ধারা এবং দুইটি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ধারা ৪এ, ১৩এ এবং ২০এ সহ ৩(৩) ও ১২(২) উপধারা। এসব সংশোধনী মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা আরো সুস্পষ্ট করে এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে যেকোনো সাধারণ নাগরিকের উপর সংঘটিত সিস্টেম্যাটিক আক্রমণকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।
এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে গুম, যৌন নির্যাতন ও অন্যান্য সহিংসতার মতো বিষয়গুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় আনা হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালকে এই ধরনের অপরাধের দায় নির্ধারণে আন্তর্জাতিক আদালতের রোম স্ট্যাটিউট অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় আইনটি আরো কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ: নিয়ম ও বিধান
নতুন প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল যদি মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত হয়, তবে সে দলকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা অপরাধী তাদের প্রতিরোধ করা এবং দেশের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, শুধু নিষিদ্ধ করাই যথেষ্ট নয়, বরং নিবন্ধন বাতিল করাও একটি বিকল্প হতে পারে।
অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আইনগতভাবে এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। এর ফলে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দল অপরাধ সংঘটন করে সুযোগ পাবে না।
বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা
আইনের সংশোধনীর একটি বড় দিক হচ্ছে বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা। নতুন প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা যেতে পারে, যাতে জনগণ বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত থাকতে পারে। এটি বিচার কার্যক্রমের প্রতি জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। এতে করে ভুক্তভোগীরা বিচার পাওয়ার আশা করতে পারবেন এবং তাদের মতামত শুনতে পাওয়া যাবে।
ডিজিটাল সাক্ষ্যগ্রহণ: আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
বর্তমান প্রস্তাবনায় ডিজিটাল সাক্ষ্যগ্রহণের পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিজিটাল প্রমাণ এবং তথ্য গ্রহণের জন্য একটি স্পষ্ট প্রক্রিয়া তৈরি করা হবে। এভাবে সাক্ষ্যগ্রহণের সময় প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাবে, যা বিচার ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করবে।
ডিজিটাল সাক্ষ্যের মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা নিজেদের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পাবেন, যা বিচার প্রক্রিয়াকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে তথ্য ছড়ানোর সম্ভাবনাও বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইন সংশোধনের ওপর মতামত: বিশেষজ্ঞদের গুরুত্ব
বিচার ও আইন সংশোধনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হচ্ছে। সংশোধনীর প্রস্তাবনায় বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সভায় অংশগ্রহণকারী আইনজ্ঞরা বলেছেন, আইনের সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে, যাতে আইনটি দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আইনটির প্রস্তাবনার মধ্যে বিশেষজ্ঞদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করে একটি সুদৃঢ় আইন তৈরি করা হবে। এতে করে জনগণের আস্থা এবং আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আরো গ্রহণযোগ্য হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
মতবিনিময় সভায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইনের সংশোধন এমনভাবে করতে হবে যাতে জনগণের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা থাকে। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করা। আমরা প্রতিশোধ চাই না, বরং সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই।”
অন্যদিকে, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, আইনটি প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলি আসামিদের অধিকার রক্ষা করবে এবং ভুক্তভোগীদেরও বিচার পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি করবে।
আইন ও বিচার বিভাগের আলোচনা
মতবিনিময় সভায় আইন ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা শেষে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আইনটিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে পরিবর্তন আনা হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে এই পরিবর্তনগুলো ন্যায়বিচারের জন্য একটি নতুন সুযোগ তৈরি করবে। আমরা আশা করি, নতুন আইনটি দেশের জনগণের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করবে এবং আন্তর্জাতিক মানের বিচার নিশ্চিত করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।