আমরা জীবনে অনেকবার হাঁচি দিয়েছি, কিন্তু কখনো কি ভেবেছি, কেন হাঁচি আসে? হাঁচির মাঝে কি শুধু বিরক্তি, নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য? হাঁচি দেয়ার পর আমরা প্রায়ই বলতে শোনা যায়, “আলহামদুলিল্লাহ” বা “ইয়ারহামুকাল্লাহ”। কিন্তু এর মানে কী? আর কেন এই সুন্নাতটি অনুসরণ করা উচিত? আসুন, এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।

হাঁচি আসলে আমাদের শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এটি শরীরের এক ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা। যখন নাকে কোনো ধুলো, পরাগ বা ক্ষতিকর কণা প্রবেশ করে, তখন শরীর একটি অটোমেটিক ব্যবস্থা হিসেবে হাঁচি দেয়। হাঁচি দিয়ে নাকের ভেতরের ক্ষতিকর কণাগুলো শরীরের বাইরে বেরিয়ে যায়। তাই হাঁচি আমাদের শরীরকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং ফুসফুসকে ভালোভাবে কাজ করতে সহায়তা করে। এটি শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি হাঁচি না আসে, তবে সেই ক্ষতিকর কণাগুলো শরীরে প্রবেশ করতে পারে, যা নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

হাঁচির প্রক্রিয়াটি অনেকটা একটি ছোট ভূমিকম্পের মতো, যেখানে শরীরের ভেতর থেকে এক ঝাঁক বাতাস বের হয়ে শরীরের ক্ষতিকর কণাগুলো বের করে দেয়। এভাবে হাঁচি আমাদের শরীরকে একটি ‘রিসেট’ দেয়। ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়াতে করা একটি গবেষণায় বলা হয়, হাঁচি নাকের টিস্যুতে আস্তরণ তৈরি করে এবং নাকের কার্যক্রম নতুন করে শুরু হয়। এই নতুন আস্তরণ তৈরি হওয়ার ফলে নাকের মধ্যে জমে থাকা ক্ষতিকর কণাগুলো বের হয়ে যায়, এবং নাকের সুরক্ষা ব্যবস্থা পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।

হাঁচি দিলে আলহামদুলিল্লাহ কেন বলতে হয়

তবে, শুধু শরীরের জন্য নয়, হাঁচি আমাদের ধর্মীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসলামিক সংস্কৃতিতে হাঁচি দেয়ার পর “আলহামদুলিল্লাহ” বলা এবং অন্যদের তা শোনানোর মাধ্যমে “ইয়ারহামুকাল্লাহ” বলা সুন্নাত হিসেবে গণ্য হয়। এটি এক ধরনের দোয়া, যা শরীরের সুস্থতা এবং আল্লাহর প্রশংসা হিসেবে দেখা হয়। রাসূল (সা.)-এর বাণী অনুযায়ী, যখন কেউ হাঁচি দেয় এবং “আলহামদুলিল্লাহ” বলে, তখন তার জবাবে “ইয়ারহামুকাল্লাহ” বলা উচিত। এই প্রথাটি ইসলামি জীবনাচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এর মাধ্যমে একে অপরের সুস্থতা কামনা করা হয় এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হাঁচির সময় কেন চোখ বন্ধ হয়ে যায়? বিজ্ঞানীরা বলেন, হাঁচি দেয়ার সময় শরীরের অনেক অঙ্গ একসঙ্গে কাজ করে। ফুসফুস থেকে জোরে বাতাস বের হয়, এবং সেই বাতাসের চাপ শরীরের অন্যান্য অংশে (যেমন চোখ) প্রভাব ফেলে। এজন্য চোখ বন্ধ হয়ে যায়। এটি এক ধরনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, যা শরীরের সুরক্ষা ব্যবস্থার অংশ। কিছু লোক একবারে অনেকবার হাঁচি দেয়, কারণ মস্তিষ্ক বারবার সংকেত পাঠাতে থাকে যে নাকে কিছু বিরক্তিকর বিষয় প্রবেশ করেছে এবং সেটি বের করে দিতে হবে।

তবে, হাঁচি আসলে শরীরের একটি পজিটিভ প্রতিক্রিয়া, কিন্তু কখনও কখনও এটি অতিরিক্ত হয়ে যেতে পারে, যেমন সর্দি বা ঠান্ডা লাগলে। এ ক্ষেত্রে, যদি কেউ তিনবার হাঁচি দেয় এবং “আলহামদুলিল্লাহ” না বলে, তখন তার জন্য স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত। তবে, হাঁচি দেয়ার সংখ্যা বেশি হলে তা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে, যেমন সাইনোসাইটিস বা অন্য কোনো ভাইরাল সংক্রমণ। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

এছাড়া, হাঁচি দেওয়ার সময় একেবারে শিষ্টাচারের দিকে নজর দেয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যখন আমরা হাঁচি দেই, তখন প্রচুর ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া আমাদের নাকের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। একটি হাঁচি প্রায় ৪০ হাজার কণা বের করতে পারে, যেগুলো অন্যের শরীরে যেতে পারে। সুতরাং, হাঁচি দেয়ার সময় অবশ্যই মুখ বা নাক টিস্যু বা কাপড় দিয়ে ঢেকে নিতে হবে। আর হাঁচির পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে, যাতে অন্যদের সংক্রমিত না হয়। হাতের তালু দিয়ে মুখ ঢেকা ঠিক নয়, কারণ তাতে জীবাণু অন্যদের কাছে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনেক ধরনের হাঁচির রেকর্ডও রয়েছে। ব্রিটেনের ডোনা গ্রিফিথস নামে এক নারী প্রায় দুই বছর ধরে অবিরত হাঁচি দিয়েছিলেন, যার সংখ্যা প্রায় এক মিলিয়ন ছিল। এমনকি চীনের একজন ব্যক্তি এত জোরে হাঁচি দিয়েছিলেন যে তার হাঁচির শব্দ ১৭৬ ডেসিবেল পর্যন্ত পৌঁছেছিল, যা একটি এয়ারহর্নের শব্দের থেকেও বেশি।

হাঁচির মাধ্যমে শরীরের সুরক্ষা ব্যবস্থা কাজ করে এবং এটি আমাদের জীবাণু এবং ক্ষতিকর কণাগুলো থেকে রক্ষা করে। এটি শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে, আর হাঁচি দেয়ার পর যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তা শুধুমাত্র শরীরের নয়, আত্মারও পবিত্রতা নিশ্চিত করে।

তবে, যেহেতু হাঁচি শরীরের একটা প্রতিক্রিয়া, কখনো কখনো এটা অস্বস্তিকর বা বিরক্তিকর হতে পারে। তবে এর উপকারিতা অনেক। এই ছোট্ট ক্রিয়া আমাদের শরীরকে অনেক সমস্যা থেকে রক্ষা করে, যেমন- ধুলাবালি, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঠিক কার্যক্রমও নিশ্চিত করে।