বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতার সংগ্রামই ছিল না; এটি ছিল একটি জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। একাত্তরের এই গৌরবময় অধ্যায় বাঙালির চেতনা, সাহস ও ত্যাগের প্রতীক। এই বিজয়ের পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুজিবনগর সরকার, মুক্তিকামী জনগণের আন্তরিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকা অপরিসীম।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা:
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে শুধু রাজনৈতিক নয়, মানবিক ও সামরিকভাবেও সাহায্য করেছিলেন। ভারত প্রায় 1 কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং খাবার দিয়েছে। যুদ্ধের শেষের দিকে, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে যৌথভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে 1,446 ভারতীয় সৈন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিল এবং অনেক আহত হয়েছিল। ভারতের আত্মত্যাগ শুধু রাজনৈতিক কৌশল নয়; এটা ছিল মানবতার প্রতি তাদের দায়িত্বের বহিঃপ্রকাশ। ভারতের পাশাপাশি রাশিয়াও বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে সমর্থন করে। জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে যেকোনো পদক্ষেপ রাশিয়া ভেটো দেয়।
পাকিস্তান ও তার মিত্রদের পরাজয়:
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান, চীন ও তাদের মিত্ররা পরাজিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে গণহত্যা চালায়, বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে এবং নারীদের ওপর নির্মমভাবে নির্যাতন চালায়। তাদের সমর্থক জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর এবং আল-শামস বাহিনী পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালির বিজয় নিশ্চিত হয়।
৭১-এর পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান:
দুঃখজনকভাবে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে হত্যার পর ৭১-এর পরাজিত শক্তি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে শুরু করে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করে, স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করে এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার নীলনকশা তৈরি করে।
বর্তমানে স্বাধীনতা বিরোধীরা মিথ্যা অপপ্রচার ও অপপ্রচারের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আড়াল করে ভিন্ন আখ্যান তৈরি করতে চায়। ইতিহাস বিকৃতির এই প্রক্রিয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
ইতিহাস পরিবর্তন করা যাবে না:
ইতিহাসের সত্য চিরকাল ঝাপসা। কোনো বিকৃত তথ্য বা মিথ্যা অপপ্রচার দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায়কে আড়াল করা সম্ভব নয়। নিজের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী জাতির কাছে এই সত্য চিরকাল প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
প্রজন্মের দায়িত্ব
আজকের প্রজন্মের দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো এবং চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখা। পাঠ্যপুস্তক, গবেষণা, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সত্যকে তুলে ধরতে হবে। তবেই আমরা ৭১-এর চেতনাকে অটুট রাখতে পারব এবং পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে পারব।
লেখক: টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে