ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর প্রথম দিনেই অনেক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাহী আদেশের ঝড় তুলবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেওয়া বক্তব্যে ট্রাম্প নিজের নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন সে বিষয়ে কিছু ধারণাও দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, অবৈধ অভিবাসী, জলবায়ুসংক্রান্ত নিয়ম, বৈচিত্র্যের নীতি, শ্রেণিবদ্ধ বা গোপন নথিসহ আরো অনেক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।
ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম দিন দপ্তরে গিয়ে একাধিক নির্বাহী আদেশে সই করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জন্য সাধারণ একটি ঘটনা। আইনি দিক বিবেচনায় আদেশগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কিংবা আদালত চাইলে অবশ্য আদেশ বাতিলও করে দিতে পারেন। কিন্তু এবার হোয়াইট হাউসে ফিরে ট্রাম্প যে বিশালসংখ্যক নির্বাহী আদেশ জারির পরিকল্পনা করেছেন, মার্কিন ইতিহাসে সেটি নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। জেনে নেওয়া যাক, প্রথম কর্মদিবসে ট্রাম্প কী কী বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন।
অবৈধ অভিবাসন
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর প্রথম দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। অবৈধ অভিবাসীদেরকে দেশ থেকে বের করে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় বিতাড়িতকরণ কর্মসূচি’ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, মেক্সিকো সীমান্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্ত তথা মেক্সিকো সীমান্তের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার নির্দেশনাও দেবেন। এ ছাড়া অভিবাসনসংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি নীতির অবসান ঘটাবেন বলেও জানিয়েছেন ট্রাম্প। এর ফলে দেশটির ফেডারেল অভিবাসন কর্তৃপক্ষ চাইলে গির্জা ও বিদ্যালয়গুলোতেও অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে পারবে।
‘মেক্সিকোতেই থাকুন’
ক্ষমতায় বসার পর প্রথম কর্মদিবসে ট্রাম্প তার ‘মেক্সিকোতেই থাকুন’ নীতি ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। ২০১৭ সালে প্রথমবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে তিনি অবৈধ অভিবাসনবিরোধী এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যার ফলে তখন প্রায় ৭০ হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে মেক্সিকো সীমান্তে শুনানির অপেক্ষায় রাখা হয়েছিল। যদিও ওইসব আশ্রয়প্রার্থীদের কেউই মেক্সিকোর নাগরিক ছিলেন না।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অবসান
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির মাটিতে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেকেই সেখানকার নাগরিক। কিন্তু ট্রাম্প মনে করেন, এটি একটি ‘হাস্যকর’ আইন। আর সে কারণে এ দফায় হোয়াইট হাউসে ঢোকার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের ১৫০ বছরের পুরনো আইনটি বাতিল করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তবে আইনটি বাতিল করা তার জন্য সহজ হবে না। কারণ জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারটি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে স্বীকৃত।
সীমান্ত বন্ধ করা
যুক্তরাষ্ট্রে ‘টাইটেল ৪২’ নামে একটি নীতি রয়েছে। এই নীতি অনুযায়ী, নাগরিকদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি মনে করলে অভিবাসনপ্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে পারে মার্কিন সরকার। সবশেষ করোনা মহামারির সময় এই নীতি প্রয়োগ করে দেশটিতে নতুন করে অভিবাসী ঢোকানো বন্ধ করা হয়েছিল। ট্রাম্প ক্ষমতা নিয়ে আবারও এই নীতি প্রয়োগ করতে চান বলে জানা যাচ্ছে।
মার্কিন গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে, এই লক্ষ্যে পূরণে ট্রাম্প প্রশাসন নতুন এমন একটি রোগ খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে, যার মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়া মেনেই মেক্সিকো সীমান্ত বন্ধ করা সম্ভব হবে।
ড্রাগ কার্টেল ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’
ড্রাগ কার্টেল তথা মাদক ব্যবসায়ীদের সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করার কথা জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ ক্ষেত্রে ড্রাগ কার্টেলকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ফলে ফেডারেল ও অঙ্গরাজ্যগুলো এদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি ব্যবহার করতে পারবে।
দেয়াল নির্মাণ
প্রথম দফায় হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পর সীমান্তে দেয়াল নির্মাণে আদেশ জারি করেছিলেন ট্রাম্প। এরপর দেয়াল তৈরির কাজ শুরু হলেও সেটি পুরোপুরি শেষ হয়নি। ফলে এ দফায় ক্ষমতা এসে নিজের অসমাপ্ত কাজ শেষ করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
শুল্ক বৃদ্ধি
নিজ দেশের পণ্য উৎপাদনকারীদের সুবিধা দিতে আমদানি করা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রিপাবলিকান দলের নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় বসার পরও একই কাজ করেছিলের ট্রাম্প। তখন চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, যা পর বাইডেন প্রশাসনও তা অব্যাহত রেখেছিল।
এবার হোয়াইট হাউসে ফিরেই শুল্কহার আরো বাড়োতে চান ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, ক্ষমতা নিয়েই তিনি চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ এবং মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করবেন। এর বাইরে অন্য দেশগুলো থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
ক্রিপ্টোকারেন্সির নতুন যুগ
এ দফায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার ফলে ক্রিপ্টোকারেন্সির ইতিহাসে নতুন এক যুগের সূচনা হবে বলে মনে করেন অনেকে। তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করার পর বিটকয়েনের মূল্য প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। কেউ কেউ এটাও বিশ্বাস করেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প সোনা ও তেলের মজুদের মতো করে বিটকয়েন মজুদেও ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
জলবায়ু ও জ্বালানি
যুক্তরাষ্ট্রে সদ্য বিদায় নেওয়া প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় থাকাকালে পরিবেশ ও জলবায়ু সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আইনের কড়াকড়ি বাড়ানোর পাশাপাশি জলবায়ু খাতে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দও দেওয়া হয়। তবে ট্রাম্প অবশ্য এখন বাইডেন প্রশাসনের নেওয়া অনেক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে চাচ্ছেন।
বাইডেনের শাসনামলে পরিবেশের কথা মাথায় রেখে সরকারি ভূমি ও উপকূলে জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান নতুন করে কূপ খনন বা ড্রিলিং নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। হোয়াইট হাউসে নিজের কর্মদিবসের নির্বাহী আদেশে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারেন ট্রাম্প। এ ছাড়া নতুন বায়ু প্রকল্প নিষিদ্ধ করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
এদিকে এবার ক্ষমতা বসে পুনরায় প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন ট্রাম্প। এর আগে ২০১৭ সালে প্রথমবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে করা আন্তর্জাতিক ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন তিনি। পরে ২০২১ সালে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর প্রথম দিনই চুক্তিতে পুনরায় যুক্ত হয়েছিলেন। ফলে এবার ট্রাম্প আবারও ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ক্যাপিটল দাঙ্গায় ক্ষমা
২০২১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় পরবর্তীতে যারা সাজা পেয়েছেন, তাদের বড় অংশই ট্রাম্পের সমর্থক। ফলে ক্ষমতায় বসার পরপরই তাদের অনেকে সাধারণ ক্ষমা পেতে পারেন বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।
গোপন নথি প্রকাশ
রবিবার নিজের বিজয় সমাবেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ক্ষমতায় বসে তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত শ্রেণিবদ্ধ বা গোপন নথিগুলো প্রকাশ করবেন। ১৯৬৩ সালে ঘটা ওই হত্যাকাণ্ড ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছিল, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ রয়েছে।
একইভাবে সিনেটর রবার্ট কেনেডি ও নাগরিক অধিকারের বিষয়ে আন্দোলন চালানো নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যাকাণ্ডের নথিগুলোও প্রকাশ করা হবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ
নির্বাচনী প্রচারণার সময় বিভিন্ন বক্তব্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ‘এক দিনের মধ্যে’ শেষ করতে পারবেন। পুরোপুরিভাবে যুদ্ধের ইতি টানতে ছয় মাস সময় লাগতে পারে বলে এরপর জানিয়েছিলেন তিনি।
তবে শপথ গ্রহণের পর প্রথম দিন ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কিনা, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া ঠিক কিভাবে যুদ্ধ থামানো হবে, সে বিষয়টিও খোলাসা করা হয়নি।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যে কোটি কোটি ডলার সামরিক অনুদান দিয়েছে, ট্রাম্প সব সময়ই সেটির কড়া সমালোচক ছিলেন।
এদিকে ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার সঙ্গে দেখা করতে চান এবং ট্রাম্পের সহযোগীরা ওই বৈঠকের ‘প্রস্তুতি সম্পন্ন করছেন’।
কিউবা ও ভেনিজুয়েলা
সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকদের তালিকা থেকে সম্প্রতি কিউবার নাম বাদ দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। ক্ষমতা নিয়ে ট্রাম্প এই সিদ্ধান্তকে বাতিল করে কিউবার নাম পুনরায় তালিকায় যুক্ত করতে পারেন বলে ধারণা করছেন অনেকে। সেই সঙ্গে ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করতে পারেন বলে জানা যাচ্ছে। এই দেশ দুটি আগেও ট্রাম্প প্রশাসনের ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল।
সূত্র : বিবিসি