আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:৫৬ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:২১
ঢাকা: জামায়াতের আমিরের সঙ্গে সৌজন্য বৈঠক এবং বৈঠক পরবর্তী সভা-সমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের আমিরের দেওয়া রাজনৈতিক বক্তব্যে সমঝোতা বা ঐক্য’র ইঙ্গিত থাকলেও বাপ-দাদার নীতি-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অসিয়ত ভুলে ‘মওদুদীবাদী’ জামায়াতের সঙ্গে কোনো প্রকার জোট গঠনের সম্ভাবনা জিরো। দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস মিলেছে।
দলীয় সূত্রমতে, ইসলামী আন্দোলনের বেশিরভাগ নেতা অধ্যাত্মবাদের চর্চা থেকে চরমোনাই পীরের হাতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের পতাকাতলে একত্রিত হয়েছেন। তাদের কাছে দুনিয়ার চেয়ে আখেরাত বড়। তারা মনে করেন জোট-রাজনীতি ইসলামপন্থীদের ক্ষতি করে। জোটগত রাজনীতিতে নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার ফলে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা কমে যায়, দাওয়াতি কাজ বন্ধ হয়ে যায়, কর্মী তৈরি বা তারবিয়তি কর্মসূচিতে স্থবরিতা সৃষ্টি হয়। এমপি-মন্ত্রী ও প্রশাসনিক লোকজনের সঙ্গে সখ্য’র কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে নিষ্ঠাপূর্ণ ধর্মীয় আবেগ, বিপ্লবী জজবা ও নিরাপস মনোভাব কমে গিয়ে অনেকটা ধান্ধা-সুযোগ-সুবিধা হাসিলের মনোভাব গড়ে ওঠে এবং একধরনের স্বার্থপর শ্রেণির উদ্ভব হয়।
এ ছাড়া সরকারের শরিক হিসেবে মন্ত্রিত্ব হাসিলে দলগুলো অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে অনেকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ইসলামপন্থিরা। এর মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থি দলগুলো আগের জৌলুস হারিয়ে ফেলে, নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে, বেশির ভাগ নেতা-কর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে বা অন্য দলে যোাগদান করে বলে মনে করেন ইসলামী আন্দোলনের নেতারা।
তারা মনে করেন, ইসলামী আন্দোলন দিন দিন জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার পেছনে মূল কারণটা হলো- বিগত দিনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটসহ অন্য কোনো রাজনৈতিক জোটে না যাওয়া। প্রচলিত রাজনৈতিক জোটগুলো এড়িয়ে চলায় দলের নেতা-কর্মীদের ধর্মীয় আবেগের শূচিতা অটুট থেকেছে। কোনো মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে সখ্য’র সুযোগ না থাকায় সুবিধাবাদী শ্রেণিরও উদ্ভব হয়নি। ফলে দলে শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা অনেকটা প্রফেশনাল কায়দায় সারাদেশ চষে বেড়িয়ে দলকে শক্তিশালী করতে পেরেছেন; যেটা ‘জোট রাজনীতির ফাঁদে’ আটকা পড়লে সম্ভব হতো না।
সূত্রমতে, দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন- বিভিন্ন ঘরানা-ফেরকার মানুষ নিয়ে ঐক্য করে বেশি দূর এগোনো যায় না। যেকোনো সময় যেকোনো অজুহাতে মুখ থুবড়ে পারে সেই ঐক্য। সুতরাং ঘটা করে রাজনৈতিক ‘ঐক্য’ সৃষ্ঠির চেয়ে বিভিন্ন ঘরানার মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ওপর জোর দেওয়া বেশি প্রয়োজন। মতপার্থক্য সত্ত্বেও পারস্পরিক সালাম-কালাম, সদ্ভাব, সম্প্রীতি, শুভেচ্ছা বিনিময়, বিপদে সহানুভূতি ও দেশ-মানবতা-ইসলাম প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাটফর্ম থেকে অভিন্ন লড়াই করা এবং জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা বেশি দরকার।
জানা গেছে, ইসলামী আন্দোলনে শুরু থেকেই এই চর্চা জারি ছিল। পরিস্থিতির কারণে অন্যরা এখন বিষয়টি অনুভব করছেন। তারা ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা, শক্তিমত্তা ও রাজনৈতিক শক্তিকে আর অবহেলা করতে পারছে না। ‘দ্বিদলীয় সিন্ডিকেট’ শাসনের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যে ইসলামপন্থিরা দাঁড়াতে পারে, সেই বিষয়টা এখন অনেকে বুঝতে পারছে।
ইসলামী আন্দোলনের নেতারা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছেন, চরমোনাইয়ে জামায়াত আমিরের সৌজন্য সফর কোনো ধরনের জোট বা ঐক্য সম্পর্কিত নয়। এটা মূলত ‘সিন্ডিকেট শাসন’র বিরুদ্ধে একটা মেসেজ ছিল। বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টিই ছিল এ সফরের উদ্দেশ্য। জামায়াত আমিরের চরমোনাই সফরের পর ইসলামী আন্দোলেনের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছিলেন, শিগগিরিই বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল চরমোনাই পীরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে যাবে।
জানা গেছে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, জামায়াত বা বিএনপর সঙ্গে জোট হবে কীসের ভিত্তিতে? কয়েকটি আসন বা মন্ত্রিত্বের নিশ্চয়তার ভিত্তিতে? বিশেষ কোনো জোটে যোগ দিয়ে অনুগ্রহের কয়েকটি এমপি হাসিল করলে গুটিকয়েক নেতার ব্যক্তিগত ফায়দা হতে পারে— ইসলাম, দেশ ও আদর্শের ফায়দা কী এখানে? বিএনপি যে জাতীয় সরকার গঠন করবে, সেই ধরনের সরকার আওয়ামী লীগও গঠন করেছিল! তাতে দেশ ও জাতির কী লাভ হয়েছে? কথিত জাতীয় সরকার কিংবা কোনো জোটে গিয়ে তাদের সকল অপকর্মের দায়ভার নিজেদের কাঁধে নেওয়ার দল কি ইসলামী আন্দোলন?
সূত্রমতে, ইসলামী আন্দোলনের পরিষ্কার চাওয়া, দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থায় যৌক্তিক পরিবর্তন আসুক, সেই পরিবর্তনের ফলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নিজস্ব শক্তিতে সংসদে যেতে চায় এবং ইসলাম, দেশ ও জাতির স্বার্থে স্বাধীনভাবে ভূমিকা রাখতে চায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির ওপর প্রেসার ক্রিয়েট করতেই চরমোনাইয়ে জামায়াতের আমিরকে স্বাগত জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন। কিন্তু, জামায়াতের ‘ধর্মীয় বিভ্রান্তি’ বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য মুলতবি বা স্থগিত কিংবা প্রত্যাহ্যার করে নেয়নি ইসলামী আন্দোলন। জামায়াতের আকিদা বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের ধর্মীয় বয়ান জারি থাকবে।
জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বাংলানিউজবিডিহাবকে বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রথমে জামায়াতের আমির পরে বিএনপির মহাসচিব আমাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। তাদের সঙ্গে মৌলিক কিছু বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। আবার বেশ কয়েকটা জায়াগা আমাদের মতপার্থক্য আছে। আন্দোলন বা নির্বাচনি জোট গঠন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা যার যার জায়গা থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি, চালিয়ে যাব।’
বাংলানিউজবিডিহাব/এজেড/পিটিএম