রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হল জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান, ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, যাতে তারা রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে সম্মানের সঙ্গে জীবন-যাপন করতে পারে। ইতিহাস ও বাস্তবতা সাক্ষ্য দেয় যে, রাষ্ট্র যখন এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তখন সমাজে প্রতিক্রিয়াশীলতা বাড়ে, সংকট গভীর হয়, এবং অস্থিরতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর যখন রাষ্ট্র বা সমাজ অন্যায়ের প্রতিক্রিয়ায় অন্ধ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে, তখন আবেগ আর উত্তেজনায় দিশেহারা হয়ে পথ হারিয়ে ফেলে। প্রতিশোধস্পৃহা, হিংসা ও রুদ্ধচিন্তা সমাজের সৃজনশীল চৈতন্যের শক্তিকে বিনষ্ট করে এবং অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে দেয়। তবে এই অন্ধকার থেকে মুক্তির পথও ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে, বিশেষ করে যেখানে শিক্ষার আলো, যুক্তির চর্চা এবং সংস্কৃতির বিকাশ সমাজকে আলোকিত করতে সক্ষম হয়েছে। একটি কল্যাণমুখী, ইতিবাচক সংস্কৃতি তখনই বিকশিত হয়, যখন জনশিক্ষা কেবল তথ্য ও প্রযুক্তির জ্ঞানদানে সীমাবদ্ধ না থেকে নাগরিকদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা, বিশ্লেষণক্ষমতা এবং সুস্থ সাংস্কৃতিক বোধ গঠনের কাজে নিবেদিত হয়। বিপরীতে যখন রাষ্ট্র ও সমাজ শিক্ষাকে কেবল পেশাভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, তখন মানবিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধকার ঘনীভূত হয়।
ইতিহাস আমাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতিফল সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, প্রতিক্রিয়াশীলতার পথে হাঁটা কোনো রাষ্ট্র বা জাতির জন্য কখনো শুভ হয়নি; বরং তা নতুন সংকট, অস্থিরতা ও সহিংসতার বীজ বপন করেছে। বিশ্ব ইতিহাসের অসংখ্য ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, স্বৈরাচারের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট উগ্র আবেগ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি কোনো জাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময়ের রক্তাক্ত অধ্যায় কিংবা রুশ বিপ্লবের পর স্টালিনবাদী কঠোরতার বাস্তবতা দেখিয়েছে, একটি অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে আরেকটি অগণতান্ত্রিক শক্তি প্রতিষ্ঠিত হলে, জাতি স্বাধীনতার পরিবর্তে নতুন নিপীড়নের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের উদাহরণই ধরা যাক। জনগণ রাজতন্ত্রের নিপীড়ন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় রাস্তায় নেমেছিল, কিন্তু সেই বিপ্লব প্রতিক্রিয়াশীলতার বশবর্তী হয়ে এক নতুন আতঙ্কের যুগ সৃষ্টি করেছিল যা ‘গিলোটিনের রাজত্ব’ নামে পরিচিত। বিপ্লবীদের একাংশ নিজেদের আদর্শিক শুদ্ধতার নামে যে নিপীড়ন চালায়, তা নতুন এক সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার দিকে দেশকে ঠেলে দেয়। একইভাবে রুশ বিপ্লবের পর স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানোর নামে স্টালিনবাদী শাসন একটি পুলিশি রাষ্ট্র তৈরি করেছিল, যেখানে স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ সীমিত হয়ে গিয়েছিল।
এইসব ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদের এক মৌলিক শিক্ষা দেয় যে, শুধু পুরনো শাসন ব্যবস্থা বা সংস্কৃতির বিরোধিতা করাই যথেষ্ট নয়, বরং তার স্থলে কী প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই জনশিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। একমাত্র সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচার ও সংস্কৃতির ইতিবাচক বিকাশের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীলতার চক্র ভাঙা সম্ভব। সঠিক শিক্ষা একটি জাতিকে শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি দেয় না, বরং ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনাও দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই প্রতিক্রিয়াশীলতা বারবার জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করেছে। একটি সদ্য স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা যে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় ‘অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার’ সংস্কৃতি ক্রমেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। এর ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রে দুর্বৃত্তায়ন শিকড় গেঁড়ে বসেছে, আর শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহিতার অভাব বাড়তে থাকে। ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা শাসকদের দুর্নীতি, দুঃশাসন ও স্বৈরাচারী প্রবণতা আমাদের ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে আছে। একদলীয় শাসনের প্রবর্তন, সামরিক শাসনের উত্থান, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ধারা—এসবই আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে ব্যাহত করেছে। অথচ জাতি যে মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছিল তা কেবল শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য ছিল না; এটি ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য।
স্বৈরশাসনের অবসানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়াশীলতার পরিবর্তে আমাদের প্রয়োজন সৃষ্টিশীল পথে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিনির্মাণের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তর। একটি জাতির প্রকৃত উন্নতি নির্ভর করে তার কাঠামোগত শক্তির ওপর, আর সেই কাঠামো গড়ে ওঠে সুপরিকল্পিত রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে। রাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও সংকীর্ণতার শৃঙ্খল ভেঙে রাষ্ট্রকে তার মৌলিক দায়িত্বগুলোর দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। বিশেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সমাজ সংস্কার। আজ যে শক্তি, সময় ও সম্পদ প্রতিক্রিয়াশীল উত্তেজনায় বিনষ্ট হচ্ছে, তা যদি শিক্ষার বিস্তার, সংস্কৃতির বিকাশ, গবেষণা, বিজ্ঞান ও ন্যায্য অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রস্তুত ও বিলিবন্টনে বিনিয়োগ করা হতো, তবে জাতির অগ্রগতি বহু দূর এগিয়ে যেত। এখানেই জনশিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সঠিক শিক্ষা কেবল পেশাগত দক্ষতা বাড়ায় না, বরং এটি একটি জাতিকে সচেতন, নৈতিক ও যুক্তিবাদী করে তোলে। প্রতিক্রিয়াশীলতার মূল শেকড় হচ্ছে অজ্ঞতা, অন্ধবিশ্বাস এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি যা শুধুমাত্র শিক্ষার আলোয় দূর করা সম্ভব। শিক্ষা যদি কেবল তথ্য প্রদানেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা জাতির কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হবে। বরং শিক্ষা হতে হবে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন, বিশ্লেষণধর্মী ও সংস্কৃতিসমৃদ্ধ, যা নাগরিকদের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে একটি ইতিবাচক, কল্যাণমুখী সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করবে।
বিশ্বসাহিত্য ও দর্শনে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব বহুবার উঠে এসেছে, যা আমাদের দেখায় প্রতিক্রিয়াশীলতা কিভাবে সমাজকে বিপথে পরিচালিত করে। রাশিয়ান সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ (ওয়ার এন্ড পিস, ১৮৬৭) উপন্যাসে আমরা দেখি, প্রতিশোধ ও যুদ্ধের সংস্কৃতি কেবল ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতাকে বিপর্যস্ত করে, কিন্তু প্রকৃত সমাধান দেয় না। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘দ্য রিপাবলিক’-এ ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় প্রজ্ঞা ও নীতির দ্বারা, প্রতিক্রিয়ার দ্বারা নয়। বাংলা সাহিত্যেও প্রতিক্রিয়াশীলতার ভয়াবহ পরিণতি প্রতিফলিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে আমরা দেখি, দারিদ্র্যের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে সংঘাত নয়, বরং সহনশীলতা ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলতাই একমাত্র পথ। ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের (১৯০৩-১৯৫০) ‘১৯৮৪’ উপন্যাসেও দেখানো হয়েছে, কিভাবে দমনমূলক শাসনব্যবস্থা একের পর এক প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম দেয় এবং জনগণের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে। জার্মান দার্শনিক হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন অনুসারে, সমাজে যে কোনো পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্য দিয়ে এগোয়। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সাময়িকভাবে এই পরিবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক পরিবর্তনই টিকে থাকে। তাই শক্তি, সময় ও সম্পদ ব্যয় করা উচিত রাষ্ট্রগঠনের কল্যাণকর দিকে, প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্তেজনায় আত্মঘাতি হওয়ার পরিবর্তে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব কেবল অপরাধ দমন করাই নয়, বরং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও। কেবল দমননীতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব নয়; জনগণের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান না করলে সমাজে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় না আনলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা নতুন প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম দেয়। দারিদ্র্য ও বঞ্চনা মানুষকে হিংসা ও প্রতিশোধের পথে ঠেলে দেয়, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। সুতরাং, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই প্রকৃত সমাধান। এখানে জনশিক্ষার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা যদি কেবল তথ্যভিত্তিক বা পেশাভিত্তিক হয়, তবে তা প্রতিক্রিয়াশীলতার শৃঙ্খল ভাঙতে পারবে না। বরং প্রয়োজন এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যা নৈতিকতা, সহনশীলতা, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাশক্তি ও গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। ব্যক্তি যখন ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য উপলব্ধি করতে শেখে, তখন সে অন্ধ প্রতিক্রিয়া থেকে দূরে থাকে এবং সৃজনশীল পথ বেছে নেয়। একটি সুসংহত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমেই বিভাজন নয়, বরং জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা সম্ভব।
এখন মৌলিক প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের পুণর্গঠনে স্থিতিশীলতা কেন জরুরি? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, একটি আধুনিক রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য হলো “ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা এবং সাংবিধানিক কাঠামোর দৃঢ়তা”। রাষ্ট্র যদি শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তবে তা তার মৌলিক কাঠামো হারিয়ে ফেলে এবং নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হয়। জাতিসংঘের এক গবেষণা অনুযায়ী দেখা যায়, যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত, সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬.১% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, কিন্তু যেখানে প্রতিহিংসার সংস্কৃতি বিরাজমান, সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগ ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। অর্থাৎ টেকসই উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা এবং ন্যায়বিচার অপরিহার্য। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ কী? অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতির প্রতিশোধ নয়, সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হলে অতীতের অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার বদলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য সুপরিকল্পিত উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। যে সময় ও শক্তি স্বৈরাচারী ও অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে আবেগী প্রতিক্রিয়ায় ব্যয় করা হচ্ছে, সেটি যদি শিক্ষা, কর্মসংস্থান, গণতন্ত্র ও সুশাসনের ভিত্তি মজবুত করতে কাজে লাগানো হয়, তবে একটি সুসংগঠিত ও কল্যাণমুখী দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আমাদের নিচের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এক. বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান এবং ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। প্রতিশোধের চেয়ে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে শাস্তির নীতি গ্রহণ করতে হবে। জনসাধারণকে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। অপরাধী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় এনে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
দুই. দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শৃঙ্খলার সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সবার জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, চাঁদাবাজি বন্ধ করা, এবং অর্থনৈতিক নীতিতে স্বচ্ছতা আনা জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব থেকেই বিশৃঙ্খলা জন্ম নেয়। তাই দক্ষতার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের প্রসারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা না গেলে, তারা পুনরায় প্রতিক্রিয়াশীলতার পথে ফিরে যেতে পারে।
তিন. রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে সুশাসন এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্র ও সমাজে প্রচলিত স্বৈরাচারী নিয়মনীতির পরিবর্তন ও সুশাসনের নিশ্চয়তা বিধান অপরিহার্য। একনায়কতন্ত্র বা প্রতিহিংসার রাজনীতি নয়, বরং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রই দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। তাই সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কল্যাণমুখী নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নয়; বরং প্রতিদিনের শাসনব্যবস্থায় জনগণের মতামত ও অধিকার নিশ্চিত করাই প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিচায়ক।
চার. জাতীয় আদর্শ ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ সাধন করা। জাতীয় ঐক্যকে সুসংহত করার জন্য অন্তর্ভুক্তির সংস্কৃতি বিস্তৃত করতে হবে। বিভাজন নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সমস্যাগুলোর গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজতে হবে। কোন বিশেষ শ্রেণি বা মতাদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে বা বাদ দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা কেবল নতুন প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম দেবে। তাই সমাজের সব শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সবাই রাষ্ট্রের উন্নয়নের অংশীদার হতে পারে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ এইসব পরিবর্তন বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষা কেবল জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, বরং এটি যুক্তিবাদ, নৈতিকতা, সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। প্রতিক্রিয়াশীলতার মূল ভিত্তি হলো অজ্ঞতা, সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার যা কেবল শিক্ষার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। যদি জনশিক্ষা শুধু তথ্য প্রদানে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা জাতির কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারবে না। বরং প্রয়োজন এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যা নাগরিকদের বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা, মানবিক মূল্যবোধ ও সমাজ সংস্কারের আদর্শে গড়ে তুলবে। শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগ করে নয়, বরং ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং জনশিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের মূল লক্ষ্য হতে হবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় নীতি ও সুসংগঠিত শিক্ষা-সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়াতলে কেবলই অন্ধকার। যে সমাজ প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়ায় পরিচালিত হয়, সেখানে স্বাধীন চিন্তা স্তব্ধ হয়, ন্যায়বিচার অবরুদ্ধ হয়, গণতন্ত্র বিপন্ন হয় এবং সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এ প্রতিক্রিয়াশীলতার পথে চললে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নেমে আসবে দুর্বিপাক। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ ও প্রতিক্রিয়ার বৃত্তে আবর্তিত হলে জাতি হিসেবে আমরা শুধু পিছিয়েই পড়ব না, আমাদের জাতীয় জীবনে সংকট আরও গভীর হয়ে দেখা দেবে। প্রতিক্রিয়াশীলতার জঞ্জাল সরিয়ে সত্যিকার উন্নয়নের পথ তৈরি করতে হলে শিক্ষা, সহিষ্ণুতা ও সুবিবেচনার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে জাতি প্রতিক্রিয়াশীলতার বদলে যুক্তিবাদ, গণতন্ত্র ও কল্যাণমুখী সংস্কৃতির পথে এগোয়, সেই জাতিই প্রকৃত উন্নতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। তাই রাষ্ট্রকে বর্তমান ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে উত্তরণ করে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নিতে হলে প্রতিশোধ নয়, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সামষ্টিক অগ্রগতির নীতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র ও সুশাসনের ভিত্তিতে সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্র বিনির্মাণই একমাত্র পথ, যাতে দেশ এগিয়ে যেতে পারে এক সমৃদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে। বাংলাদেশও সেই পথে এগিয়ে যাবে প্রতিহিংসার নয়, ন্যায়ের পথে; প্রতিক্রিয়ার নয়, সুবিবেচনার পথে; সংকীর্ণতার নয়, উদারতার পথে। শিক্ষার আলো, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আমরা গড়ে তুলব এক সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ যে দেশ কখনো পথ হারাবে না, বরং দুনিয়ার অন্যান্য জাতিগুলোর জন্য অগ্রগতির দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।
লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য (Email : [email protected])