




বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি), তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদর দফতর পিলখানায় বিদ্রোহের সময় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় হাইকোর্টে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তীতে নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেন সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। ফলে, এখনও শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই মামলার আপিল বিভাগের বিচার।
ঘটনা শুরু হয় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন সকাল ৯টার পরপরই পিলখানা বিডিআর সদর দফতর থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। বিডিআর সপ্তাহ চলছিল, প্রথমে অনেকে ভেবেছিলেন কোনও বিশেষ কর্মসূচি চলছে। তবে কিছু সময় পর জানা যায় বিদ্রোহ ঘটেছে এবং পিলখানার নিয়ন্ত্রণ জওয়ানদের হাতে চলে গেছে।
বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। এর মধ্যে পিলখানার চারদিকে সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়।
এদিকে, পিলখানার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দফতরে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে। একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। তখনকার স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মীর্জা আজম ও সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস আলোচনায় নেতৃত্ব দেন।
বিকালে শেখ হাসিনার সঙ্গেও বিদ্রোহীদের আলোচনা হয়। পরবর্তীতে, পিলখানার প্রধান ফটকের পাশের একটি রেস্তোরাঁয় আলোচনায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মন্ত্রী অংশ নেন।
গভীর রাতে, তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে করে বাইরে নিয়ে আসেন। তারা মুক্ত হন, কিন্তু পিলখানা তখনও বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অবশেষে, ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল থেকে পিলখানা শূন্য হয়ে পড়লে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের পর এর অবসান ঘটে।
পরে ওই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি আলাদা মামলা হয়। বিস্ফোরক মামলাটি এখনও বিচারিক আদালতে চলমান। তবে হত্যা মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে রায় ঘোষণা করেন। পিলখানা বিদ্রোহের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৫২ আসামির ফাঁসির রায় দেন। তিনি বলেন, “দেশের সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে পিলখানায় বিদ্রোহ ঘটানো হয়েছিল।”
রায়ের পর, নিয়ম অনুযায়ী, মামলার রায়ের সব নথিসহ আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল হাইকোর্টে আসে। সেখানে শুনানির পর, ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করে।
হাইকোর্টের রায়ে, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখা হয়। আটজনের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং চারজনকে খালাস দেওয়া হয়। এই মামলার অন্যতম আসামি বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন পিন্টু বিচার চলাকালীন সময়ে মারা যান।
পাশাপাশি, বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। তাদের মধ্যে দুই আসামি মারা যান এবং ১২ জনকে খালাস দেওয়া হয়।
এছাড়া, জজ আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ আসামির মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের রায়ের পর, সাজাপ্রাপ্ত সব আসামি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেছেন। তাদের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, “মামলাটি গত বছরে যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। আমাদের (আসামিপক্ষে) ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া আছে। শুনানির জন্য মামলাটি কার্যতালিকাতেও আছে।”
এদিকে, পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যার ঘটনা তদন্তের জন্য চলতি বছর বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়। রিট আবেদনে বিডিআর বিদ্রোহের দিনকে “সৈনিক শহীদ দিবস” হিসেবে ঘোষণা এবং হতাহতদের ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ ও বিপ্লব পোদ্দার এই রিট আবেদন করেন।
আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্টের পর যেহেতু ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন তথ্য উঠে এসেছে, অনেক প্রশ্ন উঠছে, সেহেতু আমরা মনে করি—আগে দায়ের হওয়া মামলায় সবকিছু পুরোপুরি উঠে আসেনি। সে কারণেই উত্থাপিত সব প্রশ্নের উত্তর ও সার্বিক তদন্তের মাধ্যমে যেন পূর্ণাঙ্গ বিষয়টি তুলে ধরা হয়, সে জন্য আমরা রিট দায়ের করেছিলাম।”
তিনি বলেন, “আমাদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। পাশাপাশি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। আমরা কমিশনের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। প্রতিবেদন পেলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।”