কালজয়ী কণ্ঠস্বর, দ্রোহ ও মুক্তির মন্ত্র – BanglaNewsBDHub.com |

Featured Image
PC Timer Logo
Main Logo



বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রজন্ম-পরম্পরায় এ অহর্নিশ স্রোতধারা, এ স্রোতধারায়ই বয়ে চলবে আবহমান বাংলার গতিপথ। মানবিকতা, মানুষের সেবা ও পরার্থপরতা নেতৃত্বের অবিনাশী মন্ত্র হলে সেই নেতৃত্বের আদর্শ ও চেতনা দেশজ পরিমণ্ডল গড়িয়ে বহির্বিশ্বের অঙ্গনে এক অনন্য বাতিঘর হিসেবে আবির্ভূত হয়। এমন আলোকবর্তিকা আবহমানকাল ধরে বৈশ্বিক নেতৃত্বের শিরা-উপশিরায় জ্যোতি ছড়িয়ে দেয় মানবিক সমাজ বিনির্মাণের কাঠামোতে।

উপশমের রশ্মি দেয় বিশ্বনেতৃত্বের মনোজগতে। অনুপ্রেরণার রসদ যোগান দিয়ে যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতৃত্বে, রাষ্ট্রের বাহ্যিক ও মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নের পরিকাঠামোতে।

বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে যাঁরা আজও নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর; অন্যায়- অবিচার, বৈষম্য-বর্ণবাদ, অধীনতা-পরাধীনতা উপনিবেশিকতা-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মহানায়ক হিসেবে অগ্রগণ্য, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ অবিসংবাদিত নেতার রাজনৈতিক আদর্শ, মুক্তির সংগ্রাম, কারাজীবন, বক্তব্যের মোহনীয় সুর ও সাবলীলতা, রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল এবং মৃত্যু- সবই সাধারণ মানুষের জন্য, নিপীড়িত বাঙালির জন্য ও বিশ্বমানবতার জন্য।

নেতৃত্বের সহজাত বিকাশ ঘটে মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে, পরার্থপরতার নিরেট উপলব্ধি থেকে এবং নিপীড়িত মানুষের মুক্তির চিৎকার শুনে। কণ্ঠস্বরে দ্রোহ, হৃদয়ের বিশালত্ব এবং উদার মানবিকতা থেকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ও অনন্য ভালোবাসা থেকে, নিপীড়িত মানুষের হাহাকারের করুণ সুর শুনে এবং অমরতার অনবদ্য ও অবিনাশী চেতনায় প্রলুব্ধ হয়ে।

বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটি, জল, কাদায় গড়া মহাকাব্যিক নেতৃত্ব; বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের অধিকার, মুক্তিকামী মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছেন। তিনি ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সুশাসন ও মানবাধিকারের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বৈষয্যমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য আজীবন লড়াই করেছেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অহিংসনীতির প্রভাব যেকোনো রাজনৈতিক নেতাকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৮৯৩ সালে মহাত্মা গান্ধী যুক্তরাজ্য থেকে আইনে ডিগ্রি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা যান। অপরদিকে ১৯৪৬ সালে নভেম্বর মাসে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী আসেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে। বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক বিষকে চরমভাবে পরিহার করে চলতেন। অসাম্প্রদায়িক এ মহান রাজনীতিবিদ বর্ণ, ধর্ম, গোত্র ও বৈষম্যের বিষাক্ত ছোবলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনে খুবই সচেষ্ট ছিলেন, জনসচেতনা তৈরি করেছেন এবং সর্বোপরি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করেছেন।

বৃটিশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে এই দুই রাজনৈতিক পুরোধা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বৃটিশ উৎখাতে সক্রিয় কর্মী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। বৃটিশরা ‘দ্বিজাতি তত্ত্বে’র হিংসুটে বিষ আমাদের মনস্তত্ত্বে ইনজেক্ট করে এবং ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি অবলম্বন করে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে ও দুর্ভিক্ষ লাগবে বঙ্গবন্ধু নিরলসভাবে চেষ্টা করেছেন। ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববাংলা নব্য-উপনিবেশবাদের বিষাক্ত হাতে পতিত হল। বঙ্গবন্ধু দুই দু’টি উপনিবেশবাদ-বৃটিশ ও পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের বিরূদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনি পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন এবং স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন।

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় যৌবনকাল। যৌবনকালের অধিকাংশ সময় উভয় নেতাই কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রায় চৌদ্দ বছর কারাগারে ছিলেন, মিথ্যা মামলায় সাজা হয়েছে এবং জেল খেটেছেন। স্ত্রী ও সন্তানদের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকাকালীন সময়ে মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোস করেননি। কারাগারের পাশে খননকৃত কবরটিই হতে পারতো তাঁর জীবনের শেষ ঠিকানা; তবুও তিনি বাঙালির মুক্তির প্রশ্নে অনড় ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু জাতির কিংবদন্তি কণ্ঠস্বরে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণে স্বাধীনতার সবুজ সংকেত, মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা এবং বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও এক্যবদ্ধ করার যাদুকরি মন্ত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয়েছে। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’- এমন মহাকাব্যিক ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে বাঙালি জাতি তার সঠিক পথপ্রদর্শককে খুঁজে পেয়েছিলেন এবং তিনি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন। মেজর সিদ্দিক সালিক তার Witness to Surrender বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চেও ভাষণ নিয়ে বলেছেন, ‘The crowds that had surged to the Race Course dispersed like a receding tide. They looked like a religious congregation returning from mosque or church after listening to a satisfying sermon.’

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ৪টি শর্ত জুড়ে দেন। শর্তগুলো হল- ক. সামরিক শাসন প্রত্যাহার, খ. গণপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, গ. গণহত্যার তদন্ত এবং ঘ. সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া। ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’- ৭ মার্চের ভাষণের শব্দচয়নে সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত বাঙালি জাতির দ্রোহ বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়, কারণ বাঙালি জাতির সামষ্টিক দ্রোহ এবং এ পললভূমির ভাষা বঙ্গবন্ধু তার বিশাল হৃদয়ে ধারণ করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ‘যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত’ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন্শাআল্লাহ্’- এমন ঘোষণা বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সবুজসংকেত দিয়ে সবাইকে প্রস্তত করেছেন। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’- এমন ঘোষণায় বাঙালি জাতি তার চূড়ান্ত বার্তা পেয়ে সসস্ত্র সংগ্রামে নামে। মূলত বাঙালি জাতি এ পললভূমি ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হয়। ২৬ মার্চে (২৫ মার্চ দিবাগত রাতে) বঙ্গবন্ধু ইপিআর-এ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দেন।

‘This may be my last message. From today Bangla Desh is independent. I call upon the people of Bangla Desh, wherever you are and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangla Desh and final victory is achieved.’

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং বাঙালি জাতির অদম্য সাহসিকতায় এ পললভূমি মুক্তি পায় পাকশোষণের হাত থেকে। বঙ্গবন্ধু মুক্ত এ পললভূমিতে শান্তিপ্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতা আনয়নের আজীবন সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধু অশিক্ষা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিক রাষ্ট্রের ভিত্তি বিনির্মাণে জন্য ১৯৭৩ সালে ২৩ মে ‘জুলিও কুরি মেডেল ফর পিস’ অর্জন করেন। ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের জন্য তাঁর এই অর্জন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বিশাল তাৎপর্য বহন করে।

স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ যেকোনো মানুষের মৌলিক অধিকার। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বাঙালির চিন্তার পরিকাঠামোতে শোকাবহ অভিব্যক্তি তৈরি করেছে। সদ্যস্বাধীন দেশে স্থিতিশীলতা আনয়ন, যুদ্ধাক্রান্ত দেশের অবকাঠামো বিনির্মাণ, যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিতকরণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়ন এবং গৃহহীন মানুষের অভিবাসনের মতো জটিল সমস্যাগুলোর সমাধানে সদা-তৎপর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু দেশের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তাঁকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে প্রবলভাবে আঘাত হানে। এই হত্যাকাণ্ডের হোতারা মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা ও আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করে সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে পরিচালিত করে।

সরল দৃষ্টিকোণ থেকে এ মহান নেতার জীবন পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়- বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন, রাজনৈতিক দর্শন এবং মুক্তি সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বমানবতার মুক্তি। মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য তিনি অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বঙ্গবন্ধু আবহমানকাল ধরে বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে শক্তি যোগাবে, সাহস যোগাবে এবং সারাবিশ্বে অনন্য নেতৃত্বের বাতিঘর হিসেবে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন। আর এজন্যই ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর UNESCO ৭ মার্চের ভাষণকে Memory of the world register-এর অন্তর্ভুক্ত করে। UNESCO-এর আন্তর্জাতিক পরামর্শক কমিটি (IAC), ১৩০টি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি ও ভাষণের মধ্যে ৭৮টি বিষয়কে নির্বাচিত করে যার মধ্যে ৭ মার্চের ভাষণ ৪৮তম।

পরিশেষে বলছি, মুক্তিযুদ্ধ ছিল মুক্তির আদর্শে বিশ্বাসী বাঙালি জাতির এক জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধ আমাদের রাজনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ, সাংস্কৃতিক মুক্তির যুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলা বিনির্মাণের যুদ্ধ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যমুক্ত স্বাধীন বঙ্গরাষ্ট্রের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা ও অগনিত মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও আত্মহুতির মহৎ অভিপ্রায় এবং জাতির জনকের স্বপ্ন আজও বাংলার মাটির ভিতে এবং মানুষের মননে শক্তভাবে, গভীরভাবে ও চিরস্থায়ীভাবে প্রোথিত হয়নি। আমাদের অমোঘ ও দৃঢ় প্রত্যয় হোক- আমাদের এই রক্তিম মাটির গভীরতা মননশীল হৃদয়ে ধারণ করা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লালিত স্বপ্নের চূড়ান্ত বাস্তবায়নে স্ব স্ব অবস্থান থেকে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা এবং রাষ্ট্রের অংশীজন হিসেবে সবাইকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুচারুভাবে পরিপালন করা। এটাই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

  • ৭ মার্চ
  • ঐতিহাসিক ভাষণ
  • বঙ্গবন্ধু
  • মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।