বাংলাদেশের নতুন নাম কী হবে! – BanglaNewsBDHub.com |

Featured Image
PC Timer Logo
Main Logo



২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন ছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন। সে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এ আন্দোলনের কারিগড় ছিলেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা। তারা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে ক্ষমতায় বসায়। ড. ইউনুসের পাশাপাশি তারা নিজেরাও ক্ষমতার ভাগীদার হয়। ইতিহাস বিজয়ীর পক্ষে যায়। শেখ হাসিনার পতনের পর কোটা আন্দোলন হয়ে যায় স্বাধীনতা আন্দোলন। এখন বিজয়ী পক্ষ বলছে, এটা ছিল দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন। ৫ আগস্ট বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয় এবং পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন হয়। তারা নব্যস্বাধীন দেশ সংস্কার করবেন, ঢেলে সাজাবেন, বৈষম্য বিতাড়ণ করবেন, নতুন করে সংবিধান লিখবেন। ভালো কথা, পুরাতনকে বিদায় করে নতুন স্বাধীনতা নতুন কিছু দিবে, দেশ ও জাতিকে বিনির্মাণ করবে প্রত্যাশা রাখি। তারপরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন- স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস কোনটি হবে? ২৬ মার্চের স্থলে ১ জুলাই স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বরের স্থলে ৫ আগস্ট বিজয় দিবস হবে? স্বাধীন দেশের কিছু নিদর্শন থাকে। যেমন- জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় ফুল-ফল, পশু-পাখি, মাছ প্রভৃতি কী হবে? জাতির পিতা কে হবে? দেশের নাম, সংবিধান কী হবে? হয়ত স্বাধীনতার নায়করা এ নিয়ে ভাবছেন, কাজ করছেন।

বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, নব্যস্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকবে না। তাই স্বাধীনতার প্রথমদিনেই বঙ্গবন্ধুর সমস্ত ভাস্কর্য ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তারপরেও যেটুকু ছিল বুলডোজার দিয়ে তা গুঁড়িয়ে দেযা হয়। এ স্মৃতি যাদুঘর ছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যা ৩২ নং রোডের বাড়ি (৩২ নং বাড়ি) নামে পরিচিত। এ বাড়ি ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীও এ বাড়ির কোনো ক্ষতি করেনি। নব্য-স্বাধীনতাকামীরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য চুরমার করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা সারাদেশের সমস্ত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, ভাস্কর্য ধ্বংস করে দেয়। বাকি থাকে শুধু সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এটা কেন অক্ষত রইল বুঝতে পারছি না। ১৯৪৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এ দেশ তিনবার স্বাধীন হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বাধীন হয়। নাম ধারণ করে পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়ে নাম ধারণ করে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে স্বাধীন হয়ে কী নাম ধারণ করে তাই দেখার বিষয়।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তা। তাই বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা জরুরি। বঙ্গবন্ধুর নাম মুছতে হলে বাংলাদেশের নাম মুছতে হবে। কেননা এ নামটা দেওয়া বঙ্গবন্ধুর। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর তারিখে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্র্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, ‘‘একসময় এই দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।…. একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।… জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছিÑ আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ।” এরপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামকরণটি বাস্তবে রূপ নেয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে এর নাম হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। যিনি শিশুর পিতা তিনিই শিশুর নাম রেখে গিয়েছেন। অর্থাৎ ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে আজকের যে বাংলাদেশ এর নাম দেশ অভ্যুদয়ের পূর্বেই বঙ্গবন্ধু নামকরণ করে গিয়েছেন।

দেশের নাম, সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় ফুল-ফল, পশু-পাখি, মাছ প্রভৃতি পরিবর্তন করে তদস্থলে নতুন নাম, নতুন কিছু করতে হবে। তা না হলে পরবর্তী জেনারেশন বলবে এসব কে করেছিল? ইতিহাস বলবে বঙ্গবন্ধু করেছিল। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর নাম মুছতে হলে এগুলোকেও বদলাতে হবে। নতুন স্বাধীন দেশের নৃপতিরা পুরাতন সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকার শপথ নেয়, পুরাতন স্মৃতিসৌধে যায় ফুল দিযে শ্রদ্ধা জানাতে, পুরাতন পতাকা ব্যবহার করে- এ কেমন কথা? এ কি বদলে দেওয়ার লক্ষণ? দেশকে নতুনভাবে বিনির্মাণ করতে হলে পুরাতনকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। একদিকে তারা নতুন বিনির্মাণের কথা বলে, অন্যদিকে পুরাতনকে আকড়ে ধরে। এটি কি দ্বিমুখী নীতি নয়? পুরাতন কোনো কিছু বহাল থাকলে বঙ্গবন্ধুর নাম বহাল থাকবে। বঙ্গবন্ধু থাকলে নব্য স্বাধীনতা স্থায়িত্ব পাবে না।

শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করলে হবে না, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও বাতিল করতে হবে। যারা ভাতা নেন তাদের বেশিরভাগ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ করে ২০২৪ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা প্রদান করা যেতে পারে। শেখ হাসিনা সরকার কোটা, ভাতা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণিতে রূপান্তরিত করেছে। চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটার সংখ্যা ১%/২% নয়, ৩০%। অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ হতো না। কারণ মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যের চেয়ে পদের সংখ্যা বেশি। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পোষ্যরা মিলে ৫-৬ লক্ষ লোক হতে পারে। তাও আবার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় ভর্তি। যাহোক, ২০ কোটি মানুষের দেশে ৫-৬ লক্ষ লোককে এ বাড়তি সুবিধা দেওয়া হতো। অথচ এ দেশে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকার, চাকরি পাচ্ছে না। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে, কোটা সংস্কার হয়েছে।

শুধু চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা সংস্কার হয়েছে। কিন্তু বাকি সকল ক্ষেত্রে তা বহাল আছে। যেমন- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-পুতিদের জন্য ভর্তি কোটা রয়েছে তা বাতিল করতে হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য ভর্তির ক্ষেত্রে কোটায় প্রাইমারি স্কুলে, হাই স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়তি সুবিধা পায়, চাকরির ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পায়। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা বাতিল করতে হবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরেকটি জঘণ্য কোটা বিদ্যমান রয়েছে। সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পোষ্য কোটা। এ পোষ্য কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় ও চাকরি পায়। দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের সন্তানদের জন্য কোনো কোটা নেই। কোটা আছে সবচেয়ে সুবিধাভোগী ও অগ্রসর শ্রেণির জন্য। আর এ কোটার জন্য কৃষক, শ্রমিক ও গরিব মানুষের সন্তানেরা মেধায়ও ভর্তি হতে পারে না। গরিব মানুষেরা কোটা চায় না, বাড়তি সুবিধা চায় না। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে ও চাকরিতে সমঅধিকার চায়, সমপ্রতিযোগিতা চায়। তাই নব্যস্বাধীন দেশে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ও চাকরির ক্ষেত্রে পোষ্য কোটা বাতিল করতে হবে। আর তা যদি বাতিল না করা হয়, পূর্ববৎ বহাল থাকে, তাহলে এ কেমন স্বাধীনতা? আমরা প্রত্যাশা করি নব্যস্বাধীন দেশে কোনো কোটা, বৈষম্য থাকবে না, সকল ক্ষেত্রে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে।

আর সে সংখ্যা ১%/২% নয়, ৩০%। অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ হতো না। কারণ মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যের চেয়ে পদের সংখ্যা বেশি। ২০ কোটি মানুষের দেশে ৫-৬ লক্ষ লোককে এ বাড়তি সুবিধা দেওয়া হতো। অথচ এ দেশে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকার, চাকরি পাচ্ছে না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা বাতিল করতে হবে

১৯৭১ সাল বেঁচে থাকা মানে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ বেঁচে থাকা। নব্য স্বাধীনতার নায়কদের আরো যা করতে হবে তা হলো- বঙ্গবন্ধুর বিকল্প জাতীয় নেতা, নব্যস্বাধীন দেশের জাতির পিতা হিসেবে কাউকে মনোনীত করা। আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে একটা নব্য রাজনৈতিক দল খোলা। ছাত্রলীগের বিকল্প ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে, দল ছাড়া বল নাই। শক্তি সঞ্চয় করতে হলে, দীর্ঘদিন টিকে থাকতে হলে দল লাগবে।

অনেকে বলেন, এ কেমন স্বাধীনতা! যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, সমালোচনার সুযোগ নেই, মিডিয়া ও সাংবাদিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ- ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তা তো করা হবেই। ২০২৪ এদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ এর বিজয়ী শক্তি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। বিজয়ীর দেশে পরাজিতদের রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া হয় না। যেমন-১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধু পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলামি, নেজামে ইসলামি, মুসলিম লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত শক্তি জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি পার্টি, ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ এখনো বহাল আছে। ২০২৪ এর সংগ্রাম হয়েছে ১৯৭১ এর মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের বাড়তি সুবিধার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ শত্রু হয়েছে তাদেরকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কারণে। সুতরাং ১৯৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ ২০২৪ এর স্বাধীনতা আন্দোলনে পরাজিত হয়েছে। পরাজিতদের আবার অধিকার কী? দেশের বেশির ভাগ মিডিয়া ছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগ সমর্থক।  সুতরাং তাদের আবার মতপ্রকাশের অধিকার কী? তারা তো কালো তালিকাভুক্ত হবেনই। তবে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পূর্বেই তারা সুর পাল্টিয়ে নব্যস্বাধীনতার রক্ষকে পরিণত হয়েছে।

 লেখক : সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

  • নাম
  • বাংলাদেশ
  • মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।