
‘উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবা বিল্লাল হোসেনের মদদে আমার মা, ভাই ও বোনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেদিন আমাকেও হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে জখম করে খুনিরা। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। এখন মামলা করলেও প্রধান আসামি উপদেষ্টার বাবার নাম বাদ দিয়ে পুলিশ ইচ্ছেমতো আসামিদের নাম দেয়। তারাই এখন আমাদেরকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।’
আবেগতাড়িত হয়ে এভাবেই বলছিলেন গত ৩ জুলাই কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গারা থানাধীন কড়ইবাড়ি গ্রামে একই পরিবারের তিনজনকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী রুমা আক্তার।
সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, খুনিরা প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে। এখন তো বিচার চেয়েও পাচ্ছি না; উল্টো নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
গত ৩ জুলাই হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকেই খুনিদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবা বিল্লাল মাস্টার। তার মদদেই আমার মা, ভাই ও বোনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে শিমুল চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীরা। সেদিন তাকেও কুপিয়ে জখম করা হয় জানিয়ে রুমা বলেন, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।
মামলা করলেও প্রধান আসামি উপদেষ্টার বাবার নাম বাদ দিয়ে পুলিশ ইচ্ছেমতো আসামিদের নাম দেয় জানিয়ে রুমা আক্তার বলেন, ঘটনার দিন ৯৯৯ ফোন দিয়েও প্রতিকার পায়নি। উল্টো পুলিশের উপস্থিতিতে হত্যা নিশ্চিত করা হয়।
ঘটনার পর মামলা করা হলেও আসামিদের ভয়ে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দাবি করে রুমা বলেন, বিল্লাল মাস্টারের মদদে এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়া শিমুল চেয়ারম্যানরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে হুমকি দিচ্ছে। কিছু আসামির জামিনও হয়েছে। অন্য আসামিরা প্রকাশ্যেই ঘুরছেন এলাকায়।
তিনি বলেন, আমরা শুনেছি এবং আমাদের বিশ্বাস শিমুল চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা আসিফের বাসাতেই লুকিয়ে রেখেছেন তার বাবা।
বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে রুমা বলেন, কয়েকটি দাবি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন উপস্থিত হয়েছি।উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবা বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। শিমুল চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।
হত্যার নেপথ্যের কারণ জানিয়ে রুমা আক্তার বলেন, স্থানীয়ভাবেই আমাদের পরিবারের মানুষ বিশেষ করে আমার মা ছিলেন জনপ্রিয়। মা স্থানীয় ইউপি নির্বাচনে দুইবার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনও করেছিলেন। বিএনপি সমর্থিত হওয়ায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই সন্ত্রাসীরা আমার মাকে বিজয়ী হতে দেয়নি। উল্টো জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তখন থেকেই হয়রানি করার জন্য বিভিন্ন মামলাও দিয়ে আসছিল। এমনকি মানহানি করার জন্য মাদক এবং চাঁদাবাজির মতো মামলাতেও আমার মায়ের নাম দিয়ে বদনাম করার অপচেষ্টা করে আসছিল। কারণ নির্বাচিত না হলেও এলাকার মানুষ তাদের যেকোনো বিপদ-আপদ এবং বিচার সালিশের জন্য আমার মায়ের কাছেই আসতো, যা তাদের জন্য ছিল বড় ঈর্ষার কারণ।
যেভাবে মব তৈরি করে হত্যা করা হলো সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে রুমা বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনার একদিন আগে মোবাইল চুরির ঘটনা নিয়ে শুরু হয় হট্টগোল। মোবাইল চুরির কারণে একটা ছেলেকে আমাদের গ্রামের রবিউলের বাড়িতে মারধর করা হলে তার বাবা কোনোভাবেই তার ছেলেকে বাঁচাতে না পেরে আমার মায়ের কাছে এসে সাহায্য চায়। তখন আমার মা সেখানে গিয়ে তাদের বলে, চোরটা যদি মরে যায় তাহলে তো আমরা আশপাশের সবাই ফেঁসে যাবো। হয় তাকে ছেড়ে দাও, না হয় পুলিশে দাও। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে থাকা বাচ্চু মেম্বার, রবি, শরিফ, বাছিদ, রফিক, আবু বক্কর, হারুনরা একযোগে বলে উঠে এই তুই চোরের পক্ষ ধরে আসছিস কেন? তুই নিজেও চোর এই বলে মায়ের ওপরও চড়াও হয়। আমার ভাই তা শুনে দৌড়ে গিয়ে আমার মাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এদিকে সেই চোরকে সেখান থেকে নিয়ে অন্যত্র চলে যায় শরিফের লোকজন। ছেলের খোঁজ না পেয়ে চোরের বাবা বাঙ্গরা বাজার থানায় অভিযোগ করলে বাচ্চু মেম্বার, রবিউল এবং শরিফের লোকজন আমার মাকে সন্দেহ করে যে আমার মা তাকে সহায়তা করেছে। এই অভিযোগে ২ জুলাই রাতে কড়ইবাড়ি গ্রামের তারু মিয়ার বাড়িতে শিমুল চেয়ারম্যান, আনু মেম্বারের উপস্থিতিতে বাচ্চু মেম্বার, রবিউল ও শরিফের আহ্বানে এক গোপন বৈঠক হয়। সেখানে প্রথমে আমার মাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, পরবর্তীতে আমরা বিচারপ্রার্থী হবো এই ভয়ে আমাদেরও শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
হত্যাকাণ্ড ঘটাতে টাকা লেনদেন হয় জানিয়ে তিনি বলেন, কিছু খুনি ভাড়া করা হয়। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দায়িত্ব নেয় শরিফ, আনু মেম্বার, বাছির, রকি, বাচ্চু মেম্বার, বাবুল ও রবিউলের ছেলেরা।
মামলার দায়িত্ব উপদেষ্টার বাবার কথা উল্লেখ করে তার পারমিশন আছে জানিয়ে শিমুল চেয়ারম্যান সব দেখার কথা বলেন জানিয়ে তিনি বলেন, আর মিডিয়ার দায়িত্ব নেয় জহিরুল, আবু বক্কর, মোস্তফা, বিল্লাল। সারা রাত তারা প্রস্তুতি নেয় এবং পরের দিন ৩ জুলাই সকাল ৬টায় সন্ত্রাসী কায়দায় ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী ও এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। কি নির্মমভাবে ওরা আমার চোখের সামনেই প্রথমে আমার মা, এরপর আমার ভাই ও বোনকে মেরে ফেলে যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
তাকেও ব্যাপকভাবে কোপানো হয় জানিয়ে তিনি বলেন, আমার মাথায় ৭২টি সেলাই আছে। শরীরের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে আঘাত করেনি। তারা ভেবেছিল আমি মারা গেছি। আল্লাহ তার অলৌকিক শক্তি দিয়ে হয়তোবা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
রুমা বলেন, র্যাব কয়েকজন আসামি ধরলেও পরে আর কোনো আসামি ধরা হয়নি। তবে এই মামলা নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকলেও থানা-পুলিশ তাতে কর্ণপাত করছে না জানিয়ে তিনি বলেন, এই ঘটনায় আমার বোন রিক্তা আক্তারকে বাদী করলেও আসামি সাজিয়েছে পুলিশ নিজেই। তাই প্রধান আসামি হিসেবে বিল্লাল মাস্টারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
মামলার পুনর্বিন্যাস করতে হবে দাবি করে তিনি বলেন, সেই সময় পরিবারের তিনজনের হত্যাকাণ্ড এবং বাকিরাও আহত থাকায় আমার বোন রিক্তা আক্তার মামলায় আসামিদের নাম সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি এবং মামলার আসামি নির্ধারণে পুলিশ কর্তৃক হওয়ায় অপরাধীদের অনেকের নামই বাদ পড়েছে, যেগুলো নতুন করে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে অপরাধীদের দ্রুত শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে জানিয়ে রুমা বলেন, আজকের পর থেকে আমাদের ওপর আর কোনো আঘাত আসলে এর জন্য সব দায় থাকবে উপদেষ্টা আসিফ ও তার বাবা বিল্লাল হোসেনের।
তিনি বলেন, আজকের পরে আমাদের কারো কোনো ভিন্ন বক্তব্য সামাজিক মাধ্যম বা কোথাও দেখলে আপনারা ধরে নিবেন, আসিফ মাহমুদের লোকজন জোরপূর্বক আমাদের দিয়ে সেগুলো বলিয়ে মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন। যেমন আমাদের সৎ বাবা জুয়েল হাসানকে কয়েকদিন আগে আসিফ মাহমুদের লোকজন তুলে নিয়ে জোরপূর্বক ভিন্ন বক্তব্য দিতে বাধ্য করিয়েছেন।
রুমা বলেন, আমাদের পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এই সংবাদ সম্মেলনের পর তারা (খুনিরা) আমাদের ওপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠবেন। সুতরাং এরপর আমাদের পরিবারের কারো ওপর কোনো আঘাত বা কারো কিছু হলে আপনারা সাক্ষী থাকবেন, এর সব দায় নিতে হবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে।
আসিফ মাহমুদের উদ্দেশ্যে আমাদের একটাই কথা, আমরা মা, ভাই, বোন সবাইকেই হারিয়ে শেষ। আমাদের আর শেষ কইরেন না। আমরা বাঁচতে চাই। প্লিজ আমাদের একটু বাঁচতে দিন।
সূত্র : কালের কণ্ঠ