
ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়া ২৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ আবারও পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ ক্ষমতায় ব্যবসায়ীদের এই সুযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে আরো এক হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন।
নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো টাকা জমা দিয়ে নবায়ন করতে পারছে না।
এ কারণে বিশেষ সুবিধার আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। যাদের ঋণের স্থিতি ৫০ কোটি টাকার বেশি, শুধু তাদের এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই সুবিধা দিতে চলতি বছরের শুরুতে একটি বাছাই কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বন্ধ ছিল।
বিএনপি শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ের নেতাদের ব্যবসা রয়েছে এই তালিকায়। আবার কারো কারো ব্যবসা খারাপ হয়েছে করোনাভাইরাস, ডলার-সংকটের সময়। আবার সুবিধা পাওয়া কারো কারো বিরুদ্ধে ঋণ অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এনার্জিপ্যাক গ্রুপের চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা ঋণ নিয়মিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে গ্রুপটি।
এ বিষয়ে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন রশীদ বলেন, ‘করোনাভাইরাস, ডলার-সংকট ও সরকারের বিল বকেয়া থাকায় আমাদের ঋণ খারাপ হয়ে যায়। ছয় বছর ধরে সরকার আমাদের বিল আটকে রেখেছিল। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠনের বিশেষ সুযোগ দিয়েছে।’
এনার্জিপ্যাক ছাড়া এনায়েতুর রহমান বাপ্পীর মালিকানাধীন বিল্ডট্রেড গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পাশাপাশি তার মালিকানায় থাকা ভার্গো মিডিয়ার (চ্যানেল নাইন) ঋণও পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। বিল্ডট্রেডের ঋণ এবি ব্যাংকে ও ভার্গো মিডিয়ার ঋণ রূপালী ব্যাংকে।
এ ছাড়া ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পেয়েছে বিএনপির কোষাধ্যক্ষ এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতের সৌরভ গ্রুপ, রাজশাহীর এরশাদ গ্রুপ, হবিগঞ্জে অবস্থিত ব্যবসায়ী আরিফুর রহমানের মালিকানাধীন ব্লু প্ল্যানেট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান প্যালেস রিসোর্ট, স্কাই ক্যাপিটাল ও বদর স্পিনিং মিলস। সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আরো আছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং, বেঙ্গল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল প্লাস্টিক, আবদুল মোনেম গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ, ওপেক্স সিনহা ও তানাকা গ্রুপ।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলের সময় আগুনে পুড়ে যাওয়া গাজী গ্রুপের ঋণও পুনর্গঠনের সুবিধা পেয়েছে। এই তালিকায় আরো রয়েছে জিয়া পরিবারের মালিকানায় থাকা ড্যান্ডি ডাইং লিমিটেড, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আসলাম চৌধুরীর রাইজিং স্টিল, সিলেট বিএনপির নেতা খন্দকার আবদুল মুক্তাদিরের সাবাব ফেব্রিকস, গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ওয়ান ডেনিম, ইলেকট্রনিক খাতের পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ইলেকট্রনিকস, ইফাদ গ্রুপ, এমবিয়েন্ট স্টিল (বিডি), জিপিএইচ ইস্পাত, প্রাইম গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, সিল্কওয়েজ গ্রুপ, তানাকা গ্রুপ, ডায়মন্ড স্পিনিং মিলস, মীম গ্রুপ (আলেমা টেক্সটাইল), এসএমএ গ্রুপ (এএ নিট স্পিন), বিইউসি অ্যাগ্রো, ব্লিং লেদার প্রোডাক্টস, অ্যাপেক্স ওয়েভিং ও অঙ্কুর স্পেশালাইজড কোল্ডস্টোরেজ। তবে সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোর সব প্রতিষ্ঠানই খেলাপি হয়েছে এমন নয়। কোনো কোনো গ্রুপের কিছু প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, প্রচলিত নিয়মে কোনো ঋণ খেলাপি হলে গড়ে সর্বনিম্ন সাড়ে ৪ শতাংশ এককালীন জমা দিয়ে ওই ঋণ নবায়ন করা যায়। নবায়ন করা ঋণ পরিশোধে এক বছর পর্যন্ত বিরতি (গ্রেস পিরিয়ড) ও সাত বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুবিধা পাওয়া যায়। তবে বিশেষ ক্ষমতায় দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এবারের ঋণ পুনর্গঠন সুবিধার আওতায় খেলাপি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধে ৫ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া হচ্ছে। আর মাত্র ১ শতাংশ এককালীন জমা বা ডাউন পেমেন্টে দেওয়া হচ্ছে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা। সেই সঙ্গে আছে ঋণ পরিশোধে তিন বছরে বিরতির সুযোগ।
এ বিষয়ে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) কোষাধ্যক্ষ ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেন, গাজী গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের এ ধরনের সুবিধা দেওয়াটা যৌক্তিক। তবে করোনাভাইরাস ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির মতো পুরোনো ইস্যুতে যাদের এই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, সেটি প্রয়োজন ছিল না। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধে ১৫ বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হতে পারে।
বাড়ছে খেলাপি ঋণ
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতরণ করা ব্যাংকঋণের একটি বড় অংশ এখন খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত দলটির শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ঋণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আবার দেশের অর্থনীতিতে বর্তমান মন্দাবস্থার কারণেও বহু ব্যবসায়ীর ঋণ খারাপ হতে শুরু করেছে। এ ছাড়া নতুন নীতিমালার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি হয়ে গেছে। গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা গত জুনে বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।