এশা মার্ডার : কর্মফল পাপ না ছাড়ে সন্তানেরে – BanglaNewsBDHub.com |

Featured Image
PC Timer Logo
Main Logo



ইনভেস্টিগেটিভ থ্রিলার সিনেমা হিসেবে ‘এশা মার্ডার : কর্মফল’ দর্শকদের টান টান উত্তেজনায় বুঁদ করে রাখতে সমর্থ হয়েছে। সিনেমা দেখার আগে খুঁতখুঁতে দর্শকের মনে হতে পারে- নামকরণ বোধহয় যুৎসই হলো না। ‘এশা মার্ডার’ই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সিনেমা দেখা শেষ দর্শক নিজেই মত পাল্টাবেন- নামকরন যথার্থ ও দুর্দান্ত। সুদূরপ্রসারী ও সুদূর অতীত-প্রসারী এই নামকরণ-কারিশমা।

বস্তুত, সব কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অব্যক্ত রয়ে যেতে পারে সবচেয়ে মূল্যবান কথাটা। সেটাই বোধহয় ‘কর্মফল’ নামাংশের অনুষঙ্গ। পুলিশ কর্মকর্তা চরিত্রে আজমেরী হক বাঁধন জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছেন। এশা নামের নার্সিং কলেজের এক ছাত্রী হঠাৎ খুন হয়ে যায়। তদন্তের দায়িত্ব পড়ে লিনার উপর। অনুসন্ধান করতে গিয়ে নেপথ্যের অনেক কিছুই বেরিয়ে আসে বটে, লিনা ঠিক থই পান না। গোলকধাঁধায় হাবুডুবু খান। শেষমেশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই কেস থেকে লিনাকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লিনা ও তার অধঃস্তন সহকর্মীরা বুঝতে পারেন নিরপরাধ কাউকে ফাঁসিয়ে দিয়ে মামলা-জয়ের ক্রেডিট নেবেন সিনিয়র কর্মকর্তা। হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন করে দায়ী ব্যক্তিকে সাজার মুখোমুখি করানো আর যেনতেনভাবে ‘সফল সমাপ্তি’রেখা টানা এক বিষয় নয়। দায়িত্ব হস্তান্তরের তখনো ১২ ঘণ্টা বাকি। সহকর্মীদের অনুরোধে শেষ চেষ্টায় নামেন লিনা। জয়ীও হন। উন্মোচন করেন ভিলেনের মুখোশ, নেপথ্যের সত্য। কিন্তু শেষাংশে যে নিজেরই বিভীষিকাময় কিশোরীবেলা উন্মোচিত হবেÑ ভাবতে পারেনি। দর্শকও চমকে যান এমন রসায়নে। ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে মুখরোচক খাবারদাবার শেষে একখিলি মশলাদার পান চিবানোর মতো। বোনাসটুকুই মূলকে ছাপিয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। লিনা যখন এই আজিমপুর এলাকায় থাকতেন, স্কুলে পড়তেন, এই এশার বাবাই তাকে যৌন নির্যাতন করেছেন। চাইলেও এই কদর্য স্মৃতি মন থেকে উপড়াতে পারেননি লিনা।

একজন কর্মজীবী নারীকে কী ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়, কীভাবে টিকিয়ে রাখতে হয় সংসার; আবার কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীদেরও মোকাবেলা করতে হয়। সমান দক্ষতায় দায়িত্ব পালন করলেও ‘নারী’ হিসেবে তাকে খাটো কিংবা ‘কম জোর’ হিসেবে দেখার প্রবণতা থাকেই। ঘরে-বাইরের এসব চ্যালেঞ্জ নিয়েই নারীকে এগোতে হয় সম্মুখপানে, লক্ষ্যের দিকে।
যে কোনো সার্থক থ্রিলারের বৈশিষ্ট্যÑ ক্রমান্বয়ে পরিপার্শ্বের সবাইকে খুনি মনে হবে, ভ্রম জাগবে এই তো, মুল আসামি ধরা পড়ে গেছে; কিন্তু এদের কেউই খুনি বলে প্রমাণিত হয় না। শেষপর্যন্ত এমন একজন সামনে আসে যাকে কেউই সন্দেহের তালিকায় রাখেনি। অথবা সে দৃশ্যপটেই ধরা দেয়নি। সেই ঘটনাই ঘটেছে ‘এশা মার্ডার : কর্মফল’-এ। তবে অপরাপর থ্রিলার সিনেমার সঙ্গে এর মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। শেষ হয়েও যেন রেশ থেকে যায়। অযাচিতভাবে কিছু নীতি-নৈতিকতার শিক্ষাও দিয়ে দেয়। অসাধু কর্ম করতে নেই। তাহলে কর্মফল ভোগ করতে হবে ঠিকই। নিজে সরাসরি সাজা না পেলেও পরবর্তী প্রজন্ম ঠিকই মাশুল গুনবে। তাই তো এই কেসে লিনা জিতেও যেন জেতেন না। কোথাও চাপা একটা অস্বস্তি, চোরাকাঁটা বিদ্ধ করে চলে তাকে। ফিরে আসে ঘিনঘিনে স্মৃতি।

‘এশা মার্ডার : কর্মফল’ সিনেমার বয়ন খুব চমৎকার। শুরু থেকে পর্যায়ক্রমে রেখে যাওয়া কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব মেলে শেষ প্রান্তে। শেষ হয়েও হইল না শেষ। ‘হ্যাপি এন্ডিং’ এটা নয়। এটা হচ্ছেÑ ইটটা ছুড়লে পাটকেলটা খেতে হয় ধরনের আদানপ্রদান! চিত্রনাট্য রচয়িতা ও পরিচালক এখানে যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এশা চরিত্রে নবাগতা পূজা অ্যাগনেস ক্রুজ দারুণ অভিনয় করেছেন। পুলিশ কর্মকর্তা লিনা চরিত্রে আজমেরী হক বাঁধন দর্শকের মন ভরিয়ে দিয়েছেনÑ আগেই বলেছি। মিশা সওদাগর ও সুমিত সেনগুপ্তকে এত ছোট চরিত্রে দেখে দর্শকের ঠিক পোষায়নি। গুরুত্বপূর্ণ এই দুই চরিত্র আরেকটু স্পেস দাবি করেছিল হয়তোবা।

‘এশা মার্ডার : কর্মফল’ তারকাবহুল ছবি নয়, কম পরিচিত ও নবাগতরা যথেষ্ট ভালো অভিনয়-কুশলতা দেখিয়েছেন। যার যার সাধ্য অনুযায়ী সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একটা মেয়ের শৈশব থেকে যৌবনকাল পর্যন্ত কত ধরনের ও চরিত্রের পুরুষের বিষাক্ত নখরে জর্জরিত হতে হয়, কীভাবে বিপন্ন হয় তার স্বাভাবিক জীবন, ব্যক্তিস্বাধীনতা সব কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়Ñ সেসব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এখানে এশা যা, লিনাও তাই। পুরুষকেন্দ্রিক সমাজে ক্ষমতাধর বা ক্ষমতাহীন নারী সবাই একই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েন। সংকটে সংকটে জেরবার হয় তাদের জীবন। ক্রাইম থ্রিলারে নারী অধিকার, সচেতনতা, জীবনবোধ মূল কাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমান্তরালে তুলে আনা চাট্টিখানি বিষয় নয়। সেসব বোধকরি থ্রিলারের লক্ষ্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণও নয়। এখানেই আর দশটা থ্রিলাররের সঙ্গে ‘এশা মার্ডার : কর্মফল’-এর পার্থক্য। সিনেমা শুরু হয় একটা ফোনকল দিয়ে। এশা হাঁটছেন, এসময় তার ফোনকল আসে। ওপাশ থেকে পুরুষকণ্ঠ বলেন- চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিই এশাকে চলার মতো প্রয়োজনীয় টাকা দেবেন। যেহেতু এশার নামে চারপাশে মন্দ কথা শোনা যাচ্ছে। এশার প্রতিবাদে ‘টাকা দেওয়া’ শেষপর্যন্ত ধারকর্জ পর্যন্ত গড়ায়। দ্বিতীয় দৃশ্যে মিশা সওদাগরকে থানায় দেখা যায়। জিডি করতে এসেছেন। তার ভাষ্যÑ ব্যবহারে বংশের পরিচয় প্রবাদটা বিলকুল ভুল। নইলে তার তেরো বছরের পুরোনো গৃহকর্মী কেন না বলে উধাও হয়ে যাবে!

এই সিনেমায় গানের পরিমাণ অল্প হলেও শ্রুতিমধুর ও অর্থবহুল। বিশেষ করে ‘বন্দি শুধু জানে/ মুক্ত হওয়ার মানে’। ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র পরে বিভিন্ন সময়ে তিন নারীকে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা করা হয়। কারণ হিসেবে যা দেখানো হয় সেটাকে দুর্বলই মনে হলো। এতটা ‘তুচ্ছ’ কারণে কেউ সাইকো হয়ে উঠতে পারে, এটাকে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। বিশেষ করে তিনি যদি হন একজন ডাক্তার। পেশাগত দায়িত্বশীলতা, মানবিকতার প্রথম পাঠÑ এসবের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলা যাবেÑ কমিশনখোর অমানুষ ডাক্তারও তো চারপাশে কম নেই!

খুন হওয়া এশার বাসায় কেক পাওয়া গিয়েছিল। আবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে খুনি একই কেক পাঠিয়েছে এএসপি লিনার বাসায়ও। লিনা বুঝতে পারেন, খুনের সঙ্গে এই কেকের কোনো না কোনো ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি এলাকার কোন বাসায় কে কেক তৈরি করেন অনুসন্ধানে নামেন। বেকারিতেও যান। কেকের সামগ্রী বিক্রির দোকানে গিয়ে জানা যায়, বাসায় কেক বানান মাহবুব নামের দুজন। তারা দুজনই আবার এক হাসপাতালে চাকরি করেন। অভিযান পরিচালনার মধ্যেই এক মাহবুব খুন হয়ে যান। সেসময় আরেক মাহবুব পুলিশকে বলেন, মাহবুব দোকানে চা আনতে গেছে। এসময় তার অঙ্গভঙ্গি ছিল অন্যধরনের। হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো। তার পেছনে দেখা যায় একটা কালো ছাগল। কালো অশুভের প্রতীক। এর মাধ্যমে কি পরিচালক ভিলেনকে চিনিয়ে দিলেন? পরবর্তীকালে দেখা গেল, এই ধারণাই সত্য। পরিচালক যদি সচেতনভাবেই এটা করে থাকেন, তাহলে এই ‘চিনিয়ে দেওয়া’ কতটা যুক্তিযুক্ত, কেনইবা এটা করতে হলো প্রশ্নটা থেকেই যায় বৈকি।

ছোটখাটো এমন কিছু প্রশ্ন এড়িয়ে আমরা সিনেমাটাকে ফুল মার্ক দিতে পারি। পরিচালক সানী সানোয়ার বরাবরের মতোই জাত চিনিয়েছেন। প্রত্যাশা বাড়িয়ে নিয়েছেন তার প্রতি। ভালো সিনেমা বানানোর ‘কর্মফল’ হিসেবে ভবিষ্যতে তাকে আরও ভালো সিনেমা উপহার দিয়ে যেতে হবে!

 লেখক : কথাসাহিত্যিক

  • ইনভেস্টিগেটিভ
  • এশা মার্ডার
  • কর্মফল
  • থ্রিলার
  • সিনেমা
  • মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।