টানা ২০ ঘণ্টার ভারী বর্ষণের কারণে কক্সবাজার শহর বর্তমানে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। শহরের কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনসহ সৈকত এলাকার বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট এবং কটেজ এখন পানির নিচে ডুবে রয়েছে। এতে করে বিপাকে পড়েছেন প্রায় ২৫ হাজার পর্যটক, যারা বর্তমানে হোটেলের কক্ষে আটকা পড়েছেন। জলাবদ্ধতার কারণে তারা কোথাও বের হতে পারছেন না এবং সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে লাল নিশানা উড়িয়ে তাদের সমুদ্রে নামতে নিষেধ করা হচ্ছে।
ভারী বর্ষণ ও জলাবদ্ধতা
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়, কিন্তু ভারী বর্ষণ শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টায়। এরপর রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টার ভারী বর্ষণে শহরের ৮ লাখ মানুষের জীবন অনেকটা থেমে যায়। আজ সকাল ১০টায় আবার ভারী বর্ষণ শুরু হয় এবং ঝোড়ো হাওয়াসহ আরও কয়েক ঘণ্টার ভারী বর্ষণে শহরের প্রধান সড়ক, কলাতলী সৈকত সড়কসহ অন্তত ৩৫টি উপসড়ক ডুবে যায়। এই অবস্থায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
আবহাওয়ার অবস্থা
কক্সবাজার আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ এ বি হান্নান জানিয়েছেন, গতকাল বেলা ৩টা থেকে আজ বেলা ৩টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এটি চলমান মৌসুমে এক দিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টির রেকর্ড। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে এবং বাতাসের তীব্রতাও বাড়তে পারে, যা দমকা ও ঝোড়ো হাওয়া আকারে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগে বৃদ্ধি পেতে পারে।
পর্যটকদের দুর্ভোগ
কলাতলী সৈকতের একটি গেস্টহাউস থেকে বের হওয়া পর্যটকদের একটি দল সড়কে নেমে সমুদ্রসৈকতের দিকে রওনা দিলেও পুরো সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় তারা আশ্রয় নেন একটি দোকানে। পর্যটক সোহেল আহমদ জানিয়েছেন, তারা গতকাল সকালে ঢাকা থেকে কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন এবং বৃষ্টির কারণে হোটেলে উঠে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। বিকেল পাঁচটার দিকে সুগন্ধা সৈকতে নামেন, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে গোসল করতে পারেননি। আজকের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ, বৃষ্টির থামাথামি নেই।
আরেক পর্যটক সাইফুর রহিম বলেন, “পর্যটন শহরের এমন জলাবদ্ধতা কল্পনা করা যায় না। বৃষ্টির পানি নামার কোনো পথ নেই। সড়কের পাশের নালাগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরা। যে কারণে বৃষ্টির পানি সড়কের ওপর জমে আছে। যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় পর্যটকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।”
শহরের অবস্থা
সকাল সাতটা থেকে হোটেল–মোটেল জোনের পাঁচ শতাধিক হোটেল, গেস্টহাউস, কটেজ-রিসোর্ট বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। কলাতলী সড়ক, সুগন্ধা সড়ক, সিগাল সড়ক পানিতে সয়লাব। এই তিন সড়কের দুই পাশসহ ঝিনুক মার্কেটের তিন হাজার দোকানপাট পানিতে নিমজ্জিত। ভারী বর্ষণে টিকতে না পেরে সৈকতে থাকা ৩৫টির বেশি ঘোড়া এদিক-সেদিক ছুটছে, কিছু ঘোড়া দোকানপাট ও রেস্তোরাঁয় আশ্রয় নিয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ
কক্সবাজার হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান জানিয়েছেন, জলাবদ্ধতার কারণে ১৮টি সড়ক ডুবে গেছে। ৫ শতাধিক হোটেলে অন্তত ২৫ হাজার পর্যটক অলস বসে সময় কাটাচ্ছেন। ভারী বর্ষণের কারণে তারা হোটেল থেকে কোথাও যেতে পারছেন না এবং অনেকেই হোটেল বুকিং বাতিল করে গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছেন।
গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, ভারী বর্ষণ হলেই হোটেল–মোটেল জোনে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। গত জুলাই মাসেও কয়েক দফায় শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল। বর্তমানে পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলররা জরুরি ভিত্তিতে নালা পরিষ্কার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু এখন তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
পাহাড় ধস ও প্রাণহানি
টানা বর্ষণে বৃহস্পতিবার গভীররাতে কক্সবাজার সদর উপজেলা এবং উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসের ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের দক্ষিণ ডিককূল এলাকায় পাহাড় ধসে মারা গেছে একই পরিবারের তিনজন। আর উখিয়া উপজেলার ১৪ নম্বর হাকিমপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসেও একই পরিবারের তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন।
পরবর্তী পূর্বাভাস
চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের নদীর পানি বাড়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে আগামী ২ দিন চট্টগ্রাম বিভাগের নদীর পানি দ্রুত বাড়তে পারে। কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর জেলার কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।