দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় পরিবর্তন হতে চলেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছে যে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত এবং মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি দেশজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি করেছে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
কি ঘটেছিল?
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এই তথ্য প্রকাশিত হয়। আদেশে বলা হয়, এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে যে সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেটি বাতিল করা হলো। এই পদক্ষেপে সরকার একটি নতুন পথ গ্রহণ করতে চাচ্ছে যা যেন পাঠ্যপুস্তক সংশোধন প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকর এবং প্রয়োজনীয় করে তোলে।
সমন্বয় কমিটির গঠন
এর আগে, ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব ড. খম কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং মো. ইয়ানুর রহমানকে সদস্য সচিব করে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন কয়েকজন শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা। এছাড়া, এই কমিটিতে এনসিটিবির সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন।
এই কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন প্রক্রিয়ার জন্য একটি সুষ্ঠু সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা। তবে, এতদিন ধরে এই কমিটির কার্যক্রম এবং এর সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।
বিতর্ক ও উদ্বেগ
পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটির গঠন নিয়ে বাংলাদেশের ধর্মীয় মহল কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিল। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলাম সহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিশিষ্ট আলেমদের অন্তর্ভুক্তি দাবি করে আসছিল। তারা অভিযোগ তুলেছিল যে, এই কমিটিতে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমী মুসলিম শিক্ষাবিদদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নেই।
এছাড়া, ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাদের দাবিতে বলেছিল যে, পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটিতে দুজন বিশিষ্ট আলেম থাকতে হবে। এতে আরও স্পষ্ট হয় যে, ধর্মীয় সংগঠনগুলোর একাংশ শিক্ষার মাধ্যমে জাতির মূল্যবোধ গঠনের জন্য তাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।
কমিটি বাতিলের পর পরবর্তী পদক্ষেপ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, বাতিল হওয়া কমিটি আর কার্যকর থাকবে না এবং পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের জন্য নতুন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদিও এই কমিটির বাতিলের সঙ্গে সাথে কার্যক্রম কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে, তবে সরকারের আশাবাদী যে নতুন ব্যবস্থা শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মতামত ও সবার মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
এছাড়া, কমিটি বাতিল হওয়ার পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছিল। মানববন্ধনে দেশের আলেম সমাজ এবং শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হয়ে চিহ্নিত ইসলাম ও দেশবিরোধী ব্যক্তিদের দ্রুত অপসারণ এবং দেশপ্রেমী মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল শিক্ষাবিদদের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় কমিটি ও তার গুরুত্ব
এখন প্রশ্ন উঠছে, কেন এই কমিটি বাতিল করা হলো? এর প্রধান কারণ হলো, বিভিন্ন পক্ষের মতামত এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করার অভাব। পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বিষয়, যেহেতু এটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা দেয়।
কমিটি গঠন করা হলেও, তার কার্যকারিতা নিয়ে যদি অসন্তোষ থাকে এবং সবার আস্থা অর্জিত না হয়, তবে তা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি ব্যাহত করতে পারে। সরকারের এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, তারা সমন্বয় এবং সবার মতামত গ্রহণকে গুরুত্ব দিচ্ছে, যা শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং জাতির মূল্যবোধের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ।
দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া
প্রথম দিকে, এই কমিটির বাতিলের পর কিছু ধর্মীয় সংগঠন এবং শিক্ষাবিদদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তবে, সব পক্ষের মতামত এবং আশা অনুযায়ী সরকারের এই সিদ্ধান্তটি যেন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে নতুন দিক নির্দেশ করে, তেমনটাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে। জনগণের মধ্যে এই পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলেও, কিছু এলাকায় ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে শিক্ষার অগ্রগতি নিশ্চিত করার দাবি থাকছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক সংশোধন প্রক্রিয়া একটি ধীরে চলা এবং গভীর মনোযোগ দাবি করা বিষয়। নতুন সমন্বয় এবং আলোচনার মাধ্যমে যদি বিষয়টি সমাধান করা যায়, তবে তা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। তবে সব পক্ষের মতামত গুরুত্ব দিয়ে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়াই হবে সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
বাংলা নিউজ বিডি হাব/ সাবরিনা আক্তার তিথি