আগামী বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে প্রতিফলিত করে বইয়ে গ্রাফিতি যুক্ত করা হচ্ছে এবং অনেক পুরোনো বিষয় বাদ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে, বইয়ের প্রচ্ছদে থাকা শেখ হাসিনার ছবিসংবলিত উক্তি বাদ দেওয়া এবং জাতীয় ইতিহাস আরও সুষমভাবে উপস্থাপন করা।

নতুন পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন

নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় পাঠ্যবইগুলোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাদের ভূমিকা এখন থেকে পাঠ্যবইয়ে যথাযথভাবে সন্নিবেশিত করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী, এবং জিয়াউর রহমান-এসব ব্যক্তিত্বদের অবদান ইতিহাসের অংশ হিসেবে তুলে ধরা হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের অবদানের প্রতি সমান গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনে নিহত আবু সাঈদমীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধদের বীরত্বগাথা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এই আন্দোলনের সময় এদের মতো একাধিক ছাত্র-যুবক নিহত হন। তাদের অবদান এবং বীরত্ব এবার বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে, যা শিক্ষার্থীদের ইতিহাসের সঠিক পরিচয় দেয়ার দিকে সহায়তা করবে।

পুরোনো শিক্ষাক্রমের সমালোচনা

এখন পর্যন্ত চলমান শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যবই নিয়ে নানা সমালোচনা ছিল। বিশেষ করে শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে থাকা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। স্কুলের বিভিন্ন বইয়ের পেছনে শেখ হাসিনার বিভিন্ন বাণী লেখা থাকতো, যেমন ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য যোগ্য নাগরিক হতে হবে’ অথবা ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য যোগ্যতা অর্জন করো’। এসব উদ্ধৃতির সাথে যুক্ত ছিল তার ছবি।

তবে, নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় এসব উদ্ধৃতি বাদ দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি বদলে চিরন্তন কিছু বাণী যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেমন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত চিন্তার চর্চা’, ‘ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা’, ইত্যাদি।

গ্রাফিতি: গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর সময়, শিক্ষার্থীরা সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গ্রাফিতি আঁকতে শুরু করে। পুরো ঢাকা শহরের দেয়াল, সীমানাপ্রাচীর, সড়কদ্বীপ, মেট্রোরেলের স্তম্ভ, এবং বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতি আঁকে যা ঐ সময়ের স্মৃতি ধারণ করে রেখেছে।

এই গ্রাফিতিতে ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, রাষ্ট্র-সমাজের সংস্কার, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, স্বৈরতন্ত্রের অবসান, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি বিভিন্ন উক্তি। এসব বিষয় নতুন পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে গ্রাফিতি অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ইতিহাসের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে পরিচিত হবে এবং গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো সম্পর্কে জানবে।

শিক্ষাক্রমের বৃহৎ পরিবর্তন

পতিত আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষা পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল, যার মধ্যে ছিল নবম শ্রেণির বিভাগ বিভাজন তুলে দেওয়া, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা আরও সৃজনশীলতা এবং দক্ষতা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে, এসব পরিবর্তনের কারণে মুখস্থনির্ভরতার প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছিল এবং প্রশ্ন ফাঁসের মতো সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে, শেখ হাসিনা সরকারের পরিবর্তনের পর নতুন সরকার শিক্ষাক্রম সংশোধনের পদক্ষেপ নেয়।

শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য ছিল না, তার পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি বলেন, পুরোনো পাঠ্যপুস্তকেই পরীক্ষাপদ্ধতি সংযুক্ত থাকবে, তবে তা সৃজনশীল এবং দক্ষতা নির্ভর হবে।

শোকাবহ ছাত্র-আন্দোলন

গত ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হন। পুলিশ যখন আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়, তখন তিনি বুক পেতে দাঁড়িয়ে যান এবং নিহত হন। তার মৃত্যুর পর আন্দোলনকারীরা তার জন্য স্মরণীয় করে রেখেছে। একইভাবে, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ঢাকায় নিহত হন এবং তার ‘পানি লাগবে’ স্লোগানটি আন্দোলনের প্রধান স্লোগানে পরিণত হয়।

এদেরকে এখন পাঠ্যবইয়ে বীরত্বগাথা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যাতে নতুন প্রজন্ম তাদের বীরত্ব এবং সাহস সম্পর্কে জানে।

নতুন পাঠ্যবইয়ের সংস্কার শিক্ষার্থীদের কাছে ইতিহাসকে আরও বৈচিত্র্যময় এবং সুষমভাবে উপস্থাপন করবে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান, গ্রাফিতি, এবং বীরত্বগাথা এর মাধ্যমে ছাত্র-জনতার ইতিহাস এবং সংগ্রামের মুহূর্তগুলো তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি, শেখ হাসিনার বাণী বাদ দিয়ে চিরন্তন বাণী অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগও শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসবে। এই পরিবর্তিত পাঠ্যবই ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীদের জন্য আরও সমৃদ্ধ, সৃজনশীল এবং বাস্তবসম্মত হবে।