রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটিশ সিংহাসনে তার আগমন কোনও বিশেষ কৃতিত্বের ফলস্বরূপ ছিল না, বরং এটি ছিল তার বংশানুক্রমের ফল। সিংহাসনে বসার সময়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দিন শেষ হয়ে এসেছিল। তবুও, এলিজাবেথ তার রাজত্বের সময় এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, দীর্ঘ ৭০ বছরের রাজত্ব শেষে এলিজাবেথ মৃত্যুবরণ করেন। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আজকের এই পোস্ট।
মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, এলিজাবেথ তার সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর পূর্তির ‘প্লাটিনাম জুবিলি’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করেছিলেন। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান উল্লেখ করে, নিয়ম অনুসরণ করে সিংহাসন পেলেও এলিজাবেথ তার দীর্ঘ শাসনকালে দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন।
এলিজাবেথ তার কর্তব্য নিষ্ঠার জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি নিজেকে রাজত্ব ও জনগণের জন্য সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত করেছেন। তার শাসনকালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের মুখে, রানি এলিজাবেথ রাজতন্ত্রের অবসানের দাবির মুখেও রাজ পরিবারের গুরুত্ব বজায় রাখেন এবং ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর জোট কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
রয়টার্স লিখেছিল, এলিজাবেথ পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। তবে, তার নারীবাদী ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নেটফ্লিক্সের সিরিজ ‘দ্য ক্রাউন’–এ রানির চরিত্রে অভিনয় করা অলিভিয়া কোলম্যান রানিকে ‘চূড়ান্ত নারীবাদী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই মন্তব্য যুক্তরাজ্য ও বাইরে বিতর্কের জন্ম দেয়। কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কিম ক্যাম্পবেল বলেন, রানির নারীবাদী হওয়ার বিষয়ে কিছু নির্দিষ্ট কাজ করা ছিল না, তবে উদাহরণ সৃষ্টি করে নেতৃত্ব দেওয়া বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
২০১১ সালে কমনওয়েলথ সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায়, এলিজাবেথ বলেছিলেন, ‘নারীরা পরিবর্তন আনতে পারে’। ক্যাম্পবেল বলেন, এলিজাবেথের এই বক্তব্য সমাজের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে এবং নারী ও মেয়েরা নিজেদের পূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ পাবে।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সাত দশক ধরে ব্রিটেনের সিংহাসন অলংকৃত করেছেন। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্যালেসে ৯৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর সংবাদে, বাকিংহাম প্যালেসের সামনে মানুষের শোক প্রকাশ করতে দেখা যায়।
প্রয়াত রানির প্রতিশ্রুতি ও নিবেদিত নেতৃত্ব উদাহরণ তৈরি করেছে। ক্যাম্পবেল বলেন, এলিজাবেথ দেখিয়েছেন যে নারীরা একাধারে সবকিছু করতে পারেন এবং সমাজে বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম। ১৫ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার শাসনকালে ক্ষমতায় এসেছেন, তাদের মধ্যে তিনজন নারী ছিলেন। রানির হাত ধরে মার্গারেট থ্যাচার ১৯৭৯ সালে যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়া, টেরেসা মে (২০১৬-২০১৯) এবং লিজ ট্রাস (কয়েক সপ্তাহ) অন্য দুই নারী প্রধানমন্ত্রী।
রানি এলিজাবেথ ১৫ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেখেছেন এবং তাদের প্রায় সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক বলেন, রানির নেতৃত্ব শৈলী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারীদের প্রভাবিত করবে। ক্যাম্পবেল মনে করেন, এলিজাবেথের রাজত্বের সময় ধীরগতিতে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু তিনি সব সময় সচেতনভাবে নিজের ভূমিকা পালন করেছেন।
১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনে এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর নামক রাজকুমারীর জন্ম হয়। তার বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং মা এলিজাবেথ বাউয়েস-লিয়ন। দুই সন্তানের মধ্যে এলিজাবেথ ছিলেন প্রথম। তার বোন প্রিন্সেস মার্গারেটের জন্ম ১৯৩০ সালে। এলিজাবেথের শিক্ষা শুরু হয় বাড়িতেই। তার শিক্ষক ছিলেন মারিয়ন ক্রাফোর্ড।
১৯৩৬ সালে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড পদত্যাগ করলে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ রাজা হন। ১০ বছর বয়সে এলিজাবেথ সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে পরিচিত হন। ১৬ বছর বয়সে প্রথম জনসম্মুখে আসেন। ১৯৪৫ সালে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন।
১৯৪৭ সালে এলিজাবেথ প্রিন্স ফিলিপকে বিয়ে করেন। প্রিন্স ফিলিপ গ্রিসের রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন। তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, তখন এলিজাবেথের বয়স ১৩। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর তারা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের চার সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় বর্তমান রাজা চার্লস। তার ভাই-বোনদের মধ্যে প্রিন্সেস অ্যান, প্রিন্স অ্যান্ড্রু এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড রয়েছেন।
রানি এলিজাবেথ তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে রাজ পরিবার এবং দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তার মৃত্যুতে লাখো মানুষ শোক প্রকাশ করেছে, এবং তার নেতৃত্ব ও উদাহরণ আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।