শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। ২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার সকালে রাজধানী কলম্বোতে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে তিনি শপথ নেন। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই দায়িত্ব গ্রহণের ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের আশা দেখা দিয়েছে।

শপথ নেওয়ার পর, দিশানায়েকে বলেছেন, “আমি রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করবো।” তিনি জানান, তিনি একটি স্বচ্ছ এবং ন্যায়সংগত রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবেন। দিশানায়েকে মনে করেন, রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের সমস্যা সমাধানে তিনি সবার সহযোগিতা চাইবেন।

তিনি বলেন, “আমি জাদুকর নই, কিন্তু আমি সেরা পরামর্শ চাইব এবং আমার সেরাটা করবো।” এই বক্তব্যটি তার সত্যিকার উদ্দীপনা এবং দেশের কল্যাণের জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতির পরিচয় দেয়।

গত শনিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে, দিশানায়েকে প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। দেশটির নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দের ভোট গণনা করা হয়। প্রথম গণনায়, দিশানায়েকে ৫৬ লাখ ৩৪ হাজার ৯১৫ ভোট পান, যা তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সজিথ প্রেমাদাসার তুলনায় বেশী।

নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর, দিশানায়েকে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেন, “লাখ লাখ চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এবং তারা একটি নতুন ইতিহাস লেখার অপেক্ষায়।” তিনি উল্লেখ করেন, সিংহলি, তামিল, মুসলিম—সবার ঐক্য নতুন সূচনার ভিত্তি।

দিশানায়েকের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে পৌঁছেছিল, যা মানুষের জীবনযাত্রায় কঠোর প্রভাব ফেলে।

তিনি বলেছেন, “আমাদের অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে হবে এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।” এর পাশাপাশি, দিশানায়েকে জনকল্যাণের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার মাধ্যমে দেশের ২ কোটি দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নত হবে।

গত বছরের মার্চে, শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণ গ্রহণ করে। এই ঋণ দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়েছে এবং মুদ্রার মান কমে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে। তবে, নতুন প্রেসিডেন্টের সামনে রয়েছে ঋণ পুনর্গঠনের গুরুতর চ্যালেঞ্জ।

আইএমএফের ঋণের কারণে কর বৃদ্ধি সহ নানা পদক্ষেপের ফলে অনেক মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। দিশানায়েকে বলেছেন, তিনি জনগণের উপর এই করের বোঝা কমানোর চেষ্টা করবেন। তবে, তাঁর জন্য কাজটি সহজ হবে না, কারণ পার্লামেন্টে তার দলের মাত্র তিনটি আসন রয়েছে।

অনূঢ়া কুমারা শিক্ষা খাতে নতুন করে ২০ হাজার চাকরির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোকে লাভজনক করতে হবে এবং জনকল্যাণমূলক সেবার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।”

নতুন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনে জনগণের ভূমিকা

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের নির্বাচনের প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জনগণ যে এই নির্বাচনে কতটা সক্রিয় ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভোট দেওয়ার জন্য মানুষের মাঝে উৎসাহ ছিল লক্ষণীয়। নির্বাচনের দিন, সারা দেশে মানুষ দীর্ঘ লাইন ধরে ভোট দিতে আসে। এটি প্রমাণ করে যে, তারা নিজেদের ভবিষ্যতের বিষয়ে কতটা সচেতন।

নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা শুধু ভোট দেওয়া নয়; এটি দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার একটি উপায়। জনগণের ভোটই ঠিক করে কে হবে তাদের নেতা। দিশানায়েকের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ একটি বার্তা দিয়েছে, তারা পরিবর্তন চায়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনগণের এই রায় সত্যিই প্রেরণাদায়ক। এখন নতুন প্রেসিডেন্টের ওপর জনগণের আশা ও প্রত্যাশা, দেশের উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

শুধু রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা নয়, বরং জনগণের অংশগ্রহণ এবং তাদের প্রতিক্রিয়া দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নির্বাচনের ফলাফল দেখতে দেখতে, আমরা দেখতে পাই কিভাবে জনগণের শক্তি একটি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব গঠন করতে পারে।

শপথ নিয়েছেন শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট, সামনে যে যে চ্যালেঞ্জ

নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য সামনে যে যে চ্যালেঞ্জ

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভূরাজনীতি। ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে এবং তাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। কারণ, এ দুই দেশই শ্রীলঙ্কার প্রধান ঋণদাতা।

রাজনৈতিক সংস্কারে নতুন দিশা

অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েক তার শপথের সময় রাজনৈতিক সংস্কারের উপর জোর দেন। তিনি জানান, দেশে স্বচ্ছ রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবেন। তাঁর মতে, রাজনীতিতে সঠিক নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল। জনগণের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে প্রয়োজন সৎ ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

দিশানায়েকের নেতৃত্বে, আশা করা যাচ্ছে যে নতুন আইন ও নীতিমালা তৈরি হবে। এটি শুধু সরকারের কার্যক্রমকে নয়, বরং জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতাও বৃদ্ধি করবে। তিনি জনগণের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন।

রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে গেলে শুধু নীতি পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়; বরং জনগণের সাথে সঠিক যোগাযোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে জানানোর জন্য শাসকদের উচিত তথ্য সরবরাহ করা, যাতে জনগণ বুঝতে পারে সরকার কি করছে। এটি সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করবে এবং তাদের অংশগ্রহণ বাড়াবে।

অর্থনৈতিক সংকট এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা

শ্রীলঙ্কা দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। গত বছর যা আরও বেড়ে যায়। দিশানায়েক নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই সংকট মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে হবে।” তিনি দেশের মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে হলে রপ্তানি বাড়ানো এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা প্রয়োজন। দিশানায়েকের লক্ষ্য হবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা। এভাবে, দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

দেশের কৃষি, শিল্প ও পর্যটন খাতগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে পুনর্গঠন করা হবে। সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

দিশানায়েক নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি ও জনকল্যাণমূলক সেবার পরিধি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি জানেন, সাধারণ মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে হলে তাদের আয়ের উৎস বাড়াতে হবে।

বিদেশি ঋণের বোঝা কমানোর উদ্যোগ

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে হলেও বিদেশি ঋণের বোঝা অনেক বড়। অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েক বলছেন, এই ঋণ ব্যবস্থাপনা নতুনভাবে দেখতে হবে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করে ঋণের শর্তগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

গত বছর, শ্রীলঙ্কা আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল, তবে তা জনগণের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধি করেছে। দিশানায়েক জনগণের করের বোঝা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি জানেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী এবং পরিকল্পিত উদ্যোগ।

সুতরাং, ঋণের পুনর্গঠন এবং ঋণের শর্ত পরিবর্তন করতে হলে দিশানায়েকের নেতৃত্বে প্রয়োজন একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য অনেক সুবিধা বয়ে আনতে পারে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্টের সামনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। তবে, তার নেতৃত্বে দেশের মানুষ নতুন আশা দেখছে। সঠিক পরিকল্পনা ও দৃঢ়তা দিয়ে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব।

প্রথমত, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা হবে। দিশানায়েক জানেন, দেশের মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সংস্কার কার্যকর করতে হবে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে, স্বচ্ছ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এরপর রয়েছে ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এই দুটি দেশ শ্রীলঙ্কার প্রধান ঋণদাতা।

শ্রীলঙ্কার জনগণের আশা এবং প্রত্যাশা নতুন প্রেসিডেন্টের ওপর। জনগণ দেখবে কিভাবে তিনি তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। নতুন সূচনার জন্য এখন সময় এসেছে।

অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা নতুন এক সূচনার দিকে এগোচ্ছে। জনগণের আশা এবং প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে, তাকে অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

অবশেষে, তাঁর নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কার জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে, এমনটাই প্রত্যাশা। এখন দেখার বিষয়, তিনি কিভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করবেন এবং জনগণের আশা পূরণ করবেন।