সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বীরদল ভারারিফৌদ গ্রামে ঘটে যাওয়া শিশু মুনতাহা আক্তার হত্যাকাণ্ডটি পুরো এলাকাকে শোকস্তব্ধ করেছে। মাত্র ৫ বছর বয়সী শিশুটির এই নির্মম মৃত্যু না শুধু তার পরিবারকে, বরং পুরো দেশের মানুষকে ব্যথিত করেছে। যদিও মুনতাহা নিখোঁজ হয়েছিল ৩ নভেম্বর, তার পরবর্তী দিনগুলোতে স্থানীয় ও দেশের নানা জায়গায় তার সন্ধান চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা হয়, তবুও শেষ পর্যন্ত যা বেরিয়ে আসে তা ছিল ভয়াবহ এক সত্য—শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে প্রতিবেশী গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম ও তার পরিবারের কিছু লোকের ক্ষোভ। তদন্তের শুরুতে পুলিশ ধারণা করছে যে, গৃহশিক্ষিকার মধ্যে চলে আসা কিছু ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও প্রতিশোধের কারণে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক কী ঘটেছিল, কেন এবং কীভাবে এই ঘটনা ঘটেছিল।
শুরু থেকে নিখোঁজ হওয়া মুনতাহা
মুনতাহা আক্তার, শামীম আহমদ ও রামিমা বেগমের পঞ্চম সন্তান। ৩ নভেম্বর, দুপুরে মুনতাহা তার বাবা শামীম আহমদের সঙ্গে স্থানীয় একটি ওয়াজ মাহফিলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে, সে নিজের প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে বের হয়। কিন্তু এরপর আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরিবারের সদস্যরা বহু চেষ্টা করেও তাকে খুঁজে পায়নি এবং ৪ নভেম্বর কানাইঘাট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
তবে ৬ নভেম্বর সকালে মুনতাহার লাশ পাওয়া যায়। একটি ডোবায় পুঁতে রাখা অবস্থায় ছিল তার মরদেহ। এর পর থেকেই সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে, এবং পুলিশ তদন্তে নামে।
প্রতিবেশী গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগমের ভূমিকা
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পারে যে, মুনতাহার গৃহশিক্ষিকা হিসেবে কিছুদিন আগে শামীমা বেগম (২৫) যোগ দিয়েছিল। কিন্তু মুনতাহার পরিবার জানিয়ে দেয়, সে তাদের সন্তানকে পড়ানোর জন্য নিয়মিত আসত না। একসময় মুনতাহা পরিবারের সদস্যরা তাকে পড়াতে নিষেধ করেছিল, কারণ শামীমার আচরণ ছিল খুবই খারাপ। এই নিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল।
এর পর থেকেই একাধিক ঘটনা ঘটতে থাকে। মুনতাহার কাপড় হারিয়ে যাওয়ার পর, সেগুলি শামীমার বাড়ি থেকে পাওয়া যায়। এতে চুরি বা অন্য কিছু নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। এর পরে শামীমা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিছুদিন পর মুনতাহা তাকে পড়াতে না দেওয়ায়, তার মধ্যে এক ধরনের প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নেয়। এটি হয়তো হত্যাকাণ্ডের পেছনের মূল কারণ হতে পারে।
হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত
তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, ৩ নভেম্বর রাতে মুনতাহাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। এরপর, তার লাশ ডোবায় পুঁতে রাখা হয়। নিহত মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ জানান, তার মেয়েকে শামীমা বেগম বারবার নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। মুনতাহার বাবা আরও বলেন, “একসময় তাকে আমি অনেক সাহায্য করেছিলাম, কিন্তু আজ সেই মানুষটাই আমার মেয়েকে হত্যা করেছে।”
এমনকি, শামীমা হত্যার বিষয়টি পুলিশকে স্বীকারও করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, শামীমা তার জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে।
গৃহশিক্ষিকার পরিবার এবং তাদের ভূমিকা
এ ঘটনায় শুধু শামীমা বেগম নয়, তার পরিবারও সন্দেহের চোখে রয়েছে। শামীমার মা আলিফজান বেগম (৫৫) এবং দুই প্রতিবেশী ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও নাজমা বেগম (৩৫) আটক করা হয়। এই পুরো পরিবার মুনতাহার মৃত্যুর সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বলে পুলিশ মনে করছে। তদন্তে আরো জানা যায়, শামীমার মা আলিফজান ছিল মুনতাহার লাশ গুম করতে। তিনি এক রাতে লাশ পুকুরে ফেলতে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন তাকে ধরে ফেলে পুলিশে খবর দেয়।
এমনকি, শামীমা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং তাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছিল।
পুলিশের তদন্ত এবং আদালতের রায়
মুনতাহার হত্যাকাণ্ডের পর, পুলিশ দ্রুত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। এই চারজন হলেন: শামীমা বেগম, তার মা আলিফজান বেগম, ইসলাম উদ্দিন এবং নাজমা বেগম। পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে গৃহশিক্ষিকার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করেছে।
মুনতাহার মৃত্যুতে তার পরিবার এবং প্রতিবেশী সবাই গভীর শোকের মধ্যে রয়েছেন। তার বাবা শামীম আহমদ বলেন, “আমার ফুলের মতো শিশুকে কেন এমনভাবে হত্যা করা হলো? আমি চাই, এই হত্যার বিচার হোক এবং হত্যাকারীরা যেন সর্বোচ্চ শাস্তি পায়।” মুনতাহার মা রামিমা বেগম তার মেয়ের লাশ দেখে মূর্ছা গিয়েছিলেন। তাঁর কান্না থামানো যাচ্ছিল না।
এটি একটি এমন ঘটনা, যা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মাত্র ৫ বছরের একটি শিশুর জীবন কেড়ে নেয়া, শুধু তাই নয়, এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পেছনে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভ কাজ করেছে—এটা ভাবতেই ভীষণ কষ্ট হয়।
বাংলা নিউজ বিডি হাব/ তানজিম আক্তার তিসা