সিন্ধু সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর একটি। এটি ব্রোঞ্জযুগীয় সভ্যতা, যা আনুমানিক ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সিন্ধু নদ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। সভ্যতার নাম “সিন্ধু সভ্যতা” দেওয়া হয়েছে কারণ এটি সিন্ধু নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন ভারতে প্রথম হরপ্পা নামক স্থানে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ায় অনেকে এটিকে হরপ্পা সভ্যতাও বলেন।
সিন্ধু সভ্যতা কে আবিষ্কার করেন?
সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার করেন বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে সমাদৃত। সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পেছনে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক ভুমিকা রয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে পরিচিত। এর আবিষ্কার ইতিহাস একটি আকর্ষণীয় কাহিনি, যা বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ ও গবেষকের কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ আমাদের কাছে এসেছে। এই সভ্যতার আবিষ্কারের পেছনে কিছু মূল ব্যক্তি আছেন যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
১. চার্লস ম্যাসন (১৮৪২):
চার্লস ম্যাসন তাঁর “Narratives of Various Journeys in Balochistan, Afghanistan and the Punjab” গ্রন্থে প্রথমবারের মতো হরপ্পার ধ্বংসাবশেষের উল্লেখ করেন। স্থানীয়রা তাকে “তেরো ক্রোশ” দূরে একটি প্রাচীন শহরের কথা বলেছিল, যা পরে প্রত্নতাত্ত্বিকদের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে।
২. আলেকজান্ডার কানিংহাম (১৮৭২-৭৫):
আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রথম হরপ্পার সিলমোহর প্রকাশ করেন। তিনি ভুলবশত এটিকে ব্রাহ্মী লিপি মনে করেছিলেন। তাঁর কাজ এই সভ্যতার প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক আগ্রহের সূচনা করে।
৩. জে. ফ্লিট (১৯১২):
জে. ফ্লিট আরও কিছু হরপ্পা সিলমোহর আবিষ্কার করেন, যা সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।
৪. স্যার জন মার্শাল (১৯২১-২২):
স্যার জন মার্শাল, রায়বাহাদুর দয়ারাম সাহানি, এবং মাধোস্বরূপ ভাটের নেতৃত্বে এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য পরিচালিত হয়। তাঁদের কাজের ফলে হরপ্পা এবং অন্যান্য প্রধান নগরীর নানা নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। স্যার জন মার্শালই প্রথম “সিন্ধু সভ্যতা” শব্দটি ব্যবহার করেন, যা পরে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়।
৫. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২১-২৪):
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, একজন বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন আবিষ্কার করেন। তিনি মহেঞ্জোদারোতে বৌদ্ধ স্তূপের ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের নিদর্শন খুঁজে পান।
৬. দয়ারাম সাহনি ও অন্যান্য:
দয়ারাম সাহনি হরপ্পার আবিষ্কারের জন্য পরিচিত, এবং তাঁর কাজ সিন্ধু সভ্যতার বিশাল বিস্তারকে প্রমাণ করেছে।
নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা
সিন্ধু সভ্যতা মূলত একটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা ছিল। এর বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে বোঝা যায় যে এটি অত্যন্ত উন্নত ছিল। এই সভ্যতার অধীন নগরগুলো সুশৃঙ্খল নগর পরিকল্পনা, আধুনিক পৌর জীবন এবং উন্নত শিল্পকলার পরিচায়ক ছিল। প্রায় ১৩ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই সভ্যতা উত্তরের হিমালয় থেকে দক্ষিণে ক্যাম্বে উপসাগর এবং পশ্চিমে ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে পূর্বে ভারতের উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
প্রধান নগরী ও আবিষ্কৃত নিদর্শন
সিন্ধু সভ্যতার প্রধান নগরীগুলোর মধ্যে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, চানহুদারো, সুতকাজেনডোর, লোথাল ও কালিবঙ্গাল উল্লেখযোগ্য। এই নগরীগুলোতে উন্নত নগর পরিকল্পনা, সুশৃঙ্খল রাস্তা, ঘরবাড়ি, সিলমোহর এবং নানা ধরনের শিল্পকলা দেখা গেছে।
আবিষ্কারকরা ও গবেষণা
সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা অপরিসীম। তিনি মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার বিভিন্ন নিদর্শন আবিষ্কার করেন। রাখালদাসের সঙ্গে দয়ারাম সাহনি এবং স্যার জন মার্শালও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্যার জন মার্শালই প্রথম “সিন্ধু সভ্যতা” নামে পরিচিত করেন। ১৮৭৫ সালে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ কানিংহাম প্রথম হরপ্পার অপরিচিত লিপি লেখা সিলের সন্ধান পান।
ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক
সিন্ধু সভ্যতার ভাষা এখনও প্রমাণিত হয়নি এবং এর উৎস অজ্ঞাত। তবে বিশেষজ্ঞেরা প্রোটো-দ্রাবিড়ীয়, এলামো-দ্রাবিড়ীয় অথবা প্যারা-মুন্ডা ভাষার সঙ্গে এই ভাষার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে মনে করেন। বর্তমানে ইউনেস্কো এই সভ্যতাকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
১৯২০ সাল থেকে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নস্থলগুলিতে খননকার্য শুরু হয়। ১৯৯৯ সালেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী আবিষ্কৃত হয়েছে। মহেঞ্জোদারো ছিল সিন্ধু সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
অবশেষে
সিন্ধু সভ্যতা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং উন্নত সভ্যতা ছিল, যার নগরকেন্দ্রিক উন্নত পরিকল্পনা, শিল্পকলার নিদর্শন এবং আধুনিক পৌর জীবন আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।